জন্মবার্ষিকী-ইলা মিত্রের সহযোদ্ধা সাঁওতালদের খবর কী

নাচোলের চণ্ডীপুর গ্রামের সাঁওতাল নেতা এবং সাঁওতালদের মধ্যে প্রথম কমিউনিস্ট সদস্য পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের মাতলা মাঝির বাড়ি ছিল কৃষক আন্দোলন ও কৃষক সমিতির মূল কেন্দ্রস্থলে। মানুষটির খুব মর্যাদা ও প্রভাব ছিল সাঁওতালদের মধ্যে। জমি ছিল তাঁর ২৫-৩০ বিঘা। তা ছাড়া বর্গাজমিতে চাষও করতেন।


তাঁর সাঁওতালি ভাষায় বক্তৃতার ফলে সাঁওতালদের সংগঠিত হওয়া সহজ হতো। দেশ বিভাগের আগে থেকেই নাচোলের বিভিন্ন এলাকা যেমন—চণ্ডীপুর, কৃষ্ণপুর, কেন্দুয়া, ঘাসুড়া...এসব এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সাঁওতালরা ছিলেন নাচোল এলাকার উল্লেখযোগ্য জনশক্তি।’ [ইলা মিত্র, নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, মালেকা বেগম।]
কেমন আছেন সেই সাঁওতালেরা? তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী (১৮ অক্টোবর ২০১১) উপলক্ষে সেই দ্রোহী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষের খোঁজ নিতে যাই সেই তেভাগা আন্দোলনের ওই গ্রামগুলোতে। নাচোলের নেজামপুর রেলস্টেশন থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। তার পরই ওই এলাকা, অর্থাৎ মাতলা মাঝির গ্রাম চণ্ডীপুর, কেন্দুয়া, খাসুড়া, রাওতারা ও কুসমাডাঙ্গা। সঙ্গে ছিলেন সাঁওতাল নেতা যতীন হেমব্রম।
একসময়ের ইলা মিত্রের ও তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত সাঁওতাল এলাকার দুর্দশা দেখে আজ হতাশ হতে হয়। কেননা, চণ্ডীপুর, কেন্দুয়া, ঘাসুড়া ও রাওতারা গ্রামে কোনো সাঁওতালের টিকিটিরও খোঁজ পাওয়া যাবে না। একসময়ের বড় সাঁওতাল গ্রাম কুসমাডাঙ্গায় আছে কেবল ১২-১৩টি সাঁওতাল পরিবার। এ গ্রামেই আছে কেবল তেভাগা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী একমাত্র ব্যক্তি কান্দা সরেন। এ কথা জানা গেল কেন্দুয়া গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তি গোকুলচন্দ্র রায়ের কাছে।
কুসমাডাঙ্গা গ্রামে যেতে দেখা হয় পূর্বপরিচিত ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রী ছায়া টুডুর পিসি (ফুফু) মিরু টুডুর সঙ্গে। জানালেন কান্দা সরেন তারই ভাশুর, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছেন। মিরু টুডু প্রথমে নিয়ে এলেন তাঁর বাড়িতে। সেখানে দেখা গেল মিরু টুডুর শাশুড়ি বয়স্ক নারী পানি কিসকুকে পা ছড়িয়ে বারান্দায় বসে ভাত খেতে। তেভাগা আন্দোলনের কোনো স্মৃতি আছে কি না, জানতে চাইলে পানি কিসকু অবাক ও প্রশ্নবোধক চোখে কিছুক্ষণ পরখ করলেন আমাদের। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে যতীন হেমব্রম তাঁদের মাতৃভাষায় আমাদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। শুনেই আতঙ্কিত হলেন পানি কিসকু। ভীত কণ্ঠে বললেন, ‘এত দিন পর এগলা ফের কি জানতে আসলারে বাবা। আবার কিছু হবে নাকি? আবার কি আমরা ভাত হারাব? জমি হারাব?’ তাঁর ভীত হওয়া দেখে পাশে থাকা নাতি-নাতনিরা খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। তাদের কষে ধমক দিয়ে পানি কিসকু বললেন, ‘এই চুপ! তোরা ভাতের মর্ম কি বুঝিস (ভাতের থালা দেখিয়ে)।’ ‘হামি কিছু বুলব না, তোমরা কান্দার কাছে যাও।’ সঙ্গী যতীন হেমব্রম বললেন, সে সময়ে সাঁওতালদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন এবং সব ফেলে ভারত পালিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে বয়স্ক সাঁওতালদের।
কান্দা সরেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দড়ির খাটলার ওপর শুয়ে আছেন কান্দা সরেন। বয়স জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘হামি মুরুক্ষ (মূর্খ) মানুষ, বয়স বলতে পারব না। তবে লীলাবতীর (ইলা মিত্র) সংগ্রামের সময় হামি জোয়ান ছিলাম। অনেক কিছুই নিজের চোখে দেখেছি। হামরা লীলাবতীর দলে ছিলাম না, হামরা ছিলাম জোতদার। ৩০ বিঘা জমি ছিল দাদার। তবে হামারঘে সঙ্গে লীলাবতীর দলের লোকজনের শত্রুতা ছিল না।’ প্রায় ৭৮ বছর বয়স্ক কান্দা সরেন জানালেন কুসমাডাঙ্গা ছাড়া এর আশপাশের তেভাগা আন্দোলনের ঘাঁটি গ্রামগুলোতে আর কোনো সাঁওতাল নেই। সেই আন্দোলনে পুলিশ ও স্থানীয় জোতদারের লাঠিয়াল বাহিনীর অত্যাচার, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারী নির্যাতনে দেশ ছাড়ে সাঁওতালেরা। কিছুসংখ্যক ফিরে এলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আবারও অত্যাচারিত হয়ে দেশ ছাড়ে তারা। গ্রামের পর গ্রাম হয়ে পড়ে সাঁওতালশূন্য। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ম্যালা হরের (সাঁওতাল) জমি ছিল। কুসমাডাঙ্গা মৌজার প্রায় সব জমিই ছিল হরের। এখন সব মুসলাদের (মুসলিম)। কীভাবে ওদের সব হোইল বুলতে পারব না।’ তিনি জানালেন, ১০-১২ বছর আগেও স্থানীয় দুর্বৃত্তদের হয়রানির ফলে দেশ ত্যাগ করেছে ১০-১২টি সাঁওতাল পরিবার। দুর্বৃত্তরা সাঁওতালদের খড়ের পালায় এমনকি ঘরেও আগুন দিত। বাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়ত রাতের বেলায়। নারীদের উত্ত্যক্ত করত। ফিরে আসার সময় কান্দা সরেন বলেন, ‘হামি মারা গেলে এগুলা বুলার আর কেহু থাকবে না।’
মন খারাপ হওয়া অনুভূতি নিয়ে কুসমাডাঙ্গা গ্রাম থেকে ফিরে আসতে আসতে সাঁওতাল নেতা যতীন হেমব্রম বললেন, এখনো এখানকার সাঁওতালেরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করে। সরকারের উচিত, ওই সময় যারা বসতভিটা জমিজমা ফেলে পালিয়েছে, যে জমিগুলো জাল দলিলের মাধ্যমে ভোগদখল করে আসছে জালিয়াতরা, তা উদ্ধার করে তাদের উত্তরাধিকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া অথবা ভূমিহীন আদিবাসীদের মধ্যে বিলি করা। এ ছাড়া কেন্দুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ইলা মিত্রের একটি স্মৃতিসৌধ হওয়ার কথা ছিল। এক বছর আগে আদিবাসী নেতাদের ডেকে স্থানও বাছাই করা হয়েছিল। এ প্রতিশ্রুতি স্থানীয় সাংসদ জিয়াউর রহমানের। কিন্তু এক বছর পরও কোনো কাজ শুরু হয়নি। বিষয়টি হতাশ করেছে নাচোলের আদিবাসীদের। স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হলে স্থানীয় আদিবাসীরা সেখানে উদ্যাপন করতে পারত ইলা মিত্রের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। ইলা মিত্রকে কতটুকু জানে নতুন প্রজন্মের মানুষ? এরা জানে না নাচোলের ঐতিহাসিক তেভাগার সংগ্রাম। জানে না, ইলা মিত্রের ওপর পাকিস্তানি পুলিশের নজিরবিহীন নির্মম নির্যাতন ও সাঁওতালদের সেই নিদারুণ আত্মত্যাগের কথা।
আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.