ইতিউতি-মধ্যবিত্তের বাজারি মানসম্মান by আতাউস সামাদ

দোকানপাট বা বাজারে গেলে খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। প্রতিদিন যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বদলায়, লাফিয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়, তার দরুন এমন আতঙ্কে থাকি যে ধারণাতীত বা অবিশ্বাস্য কী না কী শুনে মাথা ঘুরে যায়, ঠোঁট আর গলা শুকিয়ে যায়, চোখে অনেক রঙের তারা দেখি, সংবিৎ হারানোর অবস্থা হয় অথবা সহ্যাতীত যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে দোকানদারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে পরে তাদের হাতে নিজেই অপমানিত হই।


আর যদি বা রাগ সামলে রাখতে পারি, তাহলেও মধ্যবিত্তের ঠুনকো মর্যাদাবোধ টিকিয়ে রাখতে একটা মেকি হাসি দিয়ে সাধ্যাতীত দামে পছন্দের জিনিস কিনে দোকান থেকে বেরিয়ে গজরাতে গজরাতে বাড়ির পথ ধরি। সেই সময় যদি দোকানের সেবক বা পাহারাদার সালাম ঠুকে বলে, 'স্যার, দোয়া কইরেন।' তখন মুহূর্তের মধ্যে নকল হাসিটা ফিরিয়ে আনি এবং বলি, 'ভালো থাকবেন'। আর তা বলতে বলতে পকেট হাতড়ে প্রায় খালি হয়ে আসা মানিব্যাগটা বের করে একটা ১০ টাকার 'দোয়া' আলতো করে তার হাতে ছেড়ে দিই। লোকটা বিজয়ীর হাসি হেসে দোকানে ঢুকে পড়ে। আমার মেঘে ঢাকা মুখটা আরেক পোঁচ কালো হয়। হাতের পোঁটলাটা একটু বেশি ভারী মনে হয় তখন। বুঝতে পারি মাথার তালুটা ঘামে ভিজে উঠেছে। 'মানসম্মান' টিকিয়ে রাখতে যে অভিনয় করে গেলাম সে জন্য স্নায়ুচাপ বেড়েছিল তো। তাহলে কী হবে, ফের আলোতে এলেই মুখে আবার প্রশান্তির ভাব আর ঠোঁটে আলতো হাসি ফিরিয়ে আনতে হয়।
বাবুর সন্দেশ কেনার কাহিনীটা শোনানো হয়নি আপনাদের। বিবি ও বাবু দুজনই ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন। সবাই জানেন ডায়াবেটিক রোগীদের মিষ্টি খাওয়া বারণ। সম্ভবত সেই নিষেধাজ্ঞা মানতে মানতে একসময় মিষ্টির জন্য তৃষ্ণা প্রবল হয়ে ওঠে। বিবি খবর পেয়েছিলেন, ডায়াবেটিক রোগীদের সুখী করার জন্য একটা মিষ্টির দোকানে নাকি স্যাকারিন দিয়ে সন্দেশ তৈরি করছে। তাই তিনি বাবুকে অনুরোধ করলেন কাজ থেকে ফেরার সময় যেন ওই সন্দেশ নিয়ে আসেন। যে মিষ্টির দোকানে তা পাওয়া যাবে সেটার নামও বলে দিলেন। বাবু বিকেলের দিকে সেই দোকানে গেলেন এবং ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য নিরাপদ সন্দেশ খোঁজ করলেন। দোকানের এক কর্মচারী বললেন, 'স্যার, এখানে ওই সন্দেশ বিক্রি হয় ঠিকই; কিন্তু আজ সব শেষ হয়ে গেছে।' তারপর যোগ করলেন, 'তবে চিন্তা করবেন না। ওই যে ওখানে দেখছেন, ওগুলো ছানার সন্দেশ আর ওতে মিষ্টি খুব সামান্য। ওগুলো খেলে আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না। আর স্বাদও বেশি।' বাবু বেশ উৎসাহ নিয়েই উত্তর দিলেন, 'তাই নাকি। ভালো তো। এগুলো কত করে?' দোকানি বললেন, 'বেশি না, ত্রিশ টাকা করে এক পিস।' ওই দাম শুনে বাবুর মুখে বোধ হয় হতাশা নেমে এসেছিল। তাই দেখে দোকানির সম্ভবত সহানুভূতি হয়েছিল। তিনি বললেন, 'স্যার, কয়টা দেব, দুই পিস?' প্রশ্নটা বাবুর বুকে বড়ই বাজল। তিনি ভাবলেন, লোকটা বোধ হয় তাঁকে তাদের মিষ্টির ক্রেতা হওয়ার অযোগ্য বলে মনে করছে। তিনি এবার বেশ জোরশোরেই বললেন, 'না, না, দুটো নয়, চারটাই দিন।' ভাবলেন, পকেট খালি হয় হোক, তবু মান থাক। দোকানির হাত থেকে সন্দেশের ছোট প্যাকেটটা নিতে নিতে একটা ১০০ টাকার আর একটা ৫০ টাকার নোট এগিয়ে দিলেন। অতঃপর বাড়ির পথে রওনা হলে তাঁর কাছে রইল ফেরত পাওয়া কুড়ি টাকা আর মানিব্যাগে আরেকটা ১০ টাকার নোট_এই তিরিশ টাকা। মাথাটা ততক্ষণে ধরে এসেছে।
ফুটপাতে একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেলে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলেন। হোক না খরচ একটু 'কম মিষ্টির সন্দেশ' তো কেনা হলো! এখন বলতে বাধা নেই, বাবুটি এই অধম লেখক। জিনিসপত্রের দাম আমাদের জীবদ্দশায় এত বদলে যাবে ভাবতে পারিনি আগে।
তবে আমরা জীবনটাকে সহজভাবে নিতে চাইতাম বলেই বোধ হয় 'মূল্যস্ফীতির দানব'-এর চেহারা যে কী ভয়ংকর হবে, তা ভেবে দেখার চেষ্টা করিনি। অথচ পরিবর্তনের একটা মাপকাঠি আমার হাতের কাছেই ছিল। বলতে কি সেটা মুঠোর মধ্যে থাকত। বিকেলে বাড়ি থেকে বের হলে চলতে চলতে চীনা বাদাম খাওয়ার অভ্যাস আমার অনেক দিনের। কনিষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার দিনগুলোতে বিকেলে অফিসে ঢোকার সময় এক ঠোঙা বাদাম কিনে ঝাল-নুন লাগিয়ে চিবাতে চিবাতে ক্যান্টিন বয়কে এক কাপ গরম চা দিতে বলতাম। তারপর লোহার টাইপ রাইটাররটা সামনে টেনে বসে শুরু করতাম সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রিপোর্ট লেখা। শক্তি জোগাত বাদাম আর চা। তো গত কয়েক বছরে দুই টাকা দামের বাদামের ছোট ঠোঙাটা প্রথমে হলো তিন টাকা, তারপর চার টাকা, তারপর পাঁচ টাকা। মাঝেমধ্যে সন্দেহ জাগে, আজকালকার পাঁচ টাকা দামের বাদামের ঠোঙাটা বোধ হয় আগের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে। ওই ঠোঙাই তো দেখিয়ে দিচ্ছিল জিনিসের দাম কেমন বাড়ছে, আর টাকার দাম কতখানি করে কমছে। আমি বুঝে নিলেই তো হতো। আকলমন্দের জন্য ইশারাই 'কাফি' মানে যথেষ্ট, কিন্তু আমার যে আক্কেল নেই।
সন্দেশ কাহিনী মাস কয়েক পুরনো। সম্প্রতি হলো একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতা। সেদিন সন্ধ্যায় পথেই খিদে পাওয়ায় একটা কেক-বিস্কুটের দোকানে ঢুকে পেটিস কিনলাম। দোকানি ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে বললেন এ জন্য যে ওটা গরম করে দেবেন। দাঁড়িয়ে আছি। এর মধ্যে দেখলাম আরেক ক্রেতা কাচের কেইস থেকে লাঠি বিস্কুটের মতো কিছু কিনছেন। সেগুলো নাড়াচাড়া করার সময় বেশ সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। দোকানিকে প্রশ্ন করলাম, 'ওগুলো কী, আর দাম কেমন?' তিনি উত্তর দিলেন, 'ওটা সলটেড পাফ। ১০০ গ্রাম ৬৫ টাকা।' তিনি ১০০ গ্রাম হিসাবে দাম বলায় সেই 'এক পিস সন্দেশ' কাহিনীটি মনে পড়ে গেল। ভাবলাম, এই কনফেকশনারির বিক্রেতাও বোধ করি চেহারা দেখে আমার ক্রয়ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান, তাই ১০০ গ্রাম হিসাবে দাম বললেন। একটু রাগই হলো। তা ছাড়া ভাবলাম ১০০ গ্রামে উঠবেই বা কয়টা। মৃদু হেসে, 'আজকে দরকার নেই' বলে পেটিসের ঠোঙাটা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দিন কয়েক পর ওই কনফেকশনারিরই আরেকটা শাখায় ঢুকেছিলাম পেস্ট্রি কিনতে। সেখানে শোকেসে নানা রকম খাবার আলাদা আলাদা ট্রেতে রেখে পাশেই ছোট ছোট কার্ডে মোটা হরফে দাম লেখা আছে। তার মাঝেই চোখ পড়ল একটা ট্রেতে সেই 'সলটেড পাফ'। পাশে কার্ডে দাম লেখা ১০০ গ্রাম ৬৫ টাকা। কনফেকশনারি মালিকের বিপণন কৌশলের প্রশংসা করলাম মনে মনে। তিনি বুঝে গেছেন যে এক কিলোগ্রাম ৬৫০ টাকা হিসাবে বললে অনেকেই এ খাদ্য কিনতে আগ্রহ হারাবেন। তাই আমার মতোরাও যাতে তা কিনতে সাহস করে, সে জন্য ১০০ গ্রাম হিসাবে দাম লিখে রেখেছেন। ওই ঘোষণার মাধ্যমে এও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে মাত্র ১০০ গ্রাম পরিমাণে বিক্রি করতেও তিনি রাজি আছেন। খুশি হয়ে ২০০ গ্রাম সলটেড পাফ (সাকল্যে ১২-১৪টা) কিনে বিজয়ীর মতো বেরিয়ে এলাম। এখানে কেউ আমাকে সীমিত আয়ের লোক বলে আড়চোখে বা বাঁকা কথায় মশকারা করবেন না।
তবে ওই কনফেকশনারির মালিক সত্যিই বুদ্ধিমান। তিনি জানেন এবং জানালেন, দিন বদলায়, সেই সঙ্গে চাল বদলায়। অবশ্য কোনো কোনো ভাগ্যবানের জন্য কিছুই বদলায় না। তাঁদের জন্য সব দামই এক ব্যাপার। দিনকয়েক আগে একটা মোটামুটি মানসম্পন্ন জুতার দোকানে গিয়েছিলাম নাতির জন্য স্যান্ডেল শু কিনতে। ওই দোকানে টেকসই জুতা পাওয়া যায়। নাতি সঙ্গে ছিল না, তার পায়ের মাপটা ছিল। তাই দেখিয়েই নাতির জন্য স্যান্ডেল শু কিনলাম। এক জোড়ার দাম ৮৯০ টাকা। তবু নিলাম, নাতি বলে কথা। দোকান থেকে বের হওয়ার সময় বড়দের এক জোড়া জুতা কিছুটা পছন্দসই মনে হওয়ায় সেলসম্যানের কাছে দাম জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, 'স্যার, ওই জুতা ইমিটেশন লেদার (মেকি চামড়া) দিয়ে তৈরি। আপনাকে আসল চামড়ার এক জোড়া জুতা দেখাই।' অতঃপর তিনি ত্বরিতগতিতে সে জুতা জোড়া নিয়ে এলেন। সেগুলো দেখতে সুন্দর এবং বেশ নরম। বিক্রেতা এর প্রস্তুতকারক হিসেবে একটা বিদেশি নাম বললেন আর যোগ করলেন, 'এগুলো ব্রাজিলে তৈরি, খাঁটি চামড়া।' দাম জানতে চাইলে বললেন, আট হাজার ৬০০ টাকা। মুখে একটা ভাব এনে উত্তর দিলাম, 'ও, তাই বুঝি। কিন্তু আমি তো এখন বন্ধ জুতা কিনব না। আমার এক পায়ের আঙুলের পাশে চামড়া উঠছে। বন্ধ জুতাতে ওখানে ঘষা লাগে। ওটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমাকে স্যান্ডেলই পরতে হবে।' সেলসম্যান বললেন, 'ও, আমি স্যরি স্যার।' বাঁচলাম। উনি যদি বলতেন, 'তাহলে ওই ইমিটেশন লেদারের জুতা কার জন্য কিনতে চাইছিলেন। তাহলে মানসম্মান যেত।' মনে মনে হয়তো তেমনই ভেবেছেন। ভাবুন গিয়ে যতক্ষণ বলে না ফেলছেন ততক্ষণ ঠিক আছে। তবে মনে মনে একটা ইচ্ছা জাগল। ওই আট হাজার ৬০০ টাকার জুতা জোড়া যিনি কিনবেন, তাঁকে যদি একবার চোখের দেখা দেখতে পেতাম। আহা অন্তত একজন সফল মানুষের চেহারা দেখে ধন্য হতাম!' চাল, ডাল, ছোলা, তেল, বেগুন, আলু, মাছ_এসবের এবং হঠাৎ দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠা চিনির দাম নিয়ে দুশ্চিন্তা করার জন্য লোকজন তো আমরাই আছি। দোয়া করি, দামি জুতা পরে আরো সাফল্যের দিকে নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাবেন তিনি এবং তার মতো অন্যরা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট

No comments

Powered by Blogger.