যুদ্ধাপরাধীদের বিচার by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

বাঙালি জাতি একদিকে যেমন সংগ্রামী, অন্যদিকে প্রচণ্ড সংযমী ও ধৈর্যশীল। আমাদের যত ভালো অর্জন, তা সম্ভব হয়েছে কঠোর পরিশ্রম এবং মানুষের মধ্যকার সহনশীলতার মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ সব কিছুর পেছনে রয়েছে সংগ্রাম এবং ধীরে পথচলার নীতি।


ভারত বিভক্তির পর বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের মধ্যে প্রথমেই ভাষার ওপর আঘাত হানা হয়। বাঙালি জাতি দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। এর পেছনে যেমন ছিল সঠিক নেতৃত্ব, সংগ্রামী চেতনা, তেমনি ছিল প্রচণ্ড ধৈর্য। তিল তিল করে গড়ে ওঠা সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, বর্তমানে বিশ্বের সব দেশ নিজেদের ভাষাকে সম্মান দেখানোর জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে আর বড় গৌরব কী হতে পারে? ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা আসে মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘদিনের শোষণ আর বঞ্চনা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সহ্য করে এসেছিল। তবুও এ দেশের জনগণ ধৈর্যচ্যুত হননি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছিলেন সংগ্রামী চেতনার কথা, আবার ধৈর্যের সঙ্গে সব কিছু মোকাবিলা করার প্রেরণা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যখন সরকার গঠন করতে সক্ষম হননি, তখনো বঙ্গবন্ধু ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। জাতিকে ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। অপেক্ষা করেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন, কিন্তু ধৈর্য হারাতে বলেননি। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তার প্রমাণ মেলে। তাঁর মতো দূরদর্শী মানুষের পক্ষে তা-ই মানায়। তিনি হয়তো ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারতেন, কিন্তু তা না করে শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন। বাঙালি যে কতটা ধৈর্যশীল, তার প্রমাণ আমরা অক্ষরে অক্ষরে পাই ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করার মধ্য দিয়ে। জনতা বঙ্গবন্ধুর কথায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমরা পাই একটি স্বাধীন মানচিত্র।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা এর বিরোধিতা করেছিল, তারাই ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বেঁচে যান। খুনিরা ভেবেছিল তাদের অপরাধের শাস্তি কখনো হবে না। দম্ভ করে খুনের কথা স্বীকার করেছিল। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, খুনিরা শাস্তি পেয়েছে। এখানেও বঙ্গবন্ধুর মতো তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার মধ্যে ধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতো যেমন সংগ্রামী, তেমনি ধৈর্যশীল। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে খুনিদের বিচার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমান কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো বিশেষ বিচারের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর সৎ, মেধাবী অফিসারদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলাননি। তিনি বিচারকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দেওয়ার পক্ষে এবং সে কাজটিই করেছেন। দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক এমনকি সাধারণ মানুষও হয়তো তখন তাঁকে দারুণভাবে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বিচারের গ্রহণযোগ্যতা বলে তো কথা আছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বিচারের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের রায় কার্যকর করেছেন। জাতির কাছে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি এবং ওঠার আশঙ্কাও নেই। এটি সম্ভব হয়েছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে। আমি এর জন্য প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে অন্যতম ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। ধারণা করা হয়, আওয়ামী লীগের এ ধরনের আশ্বাস তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করেছিল, যার জন্য আওয়ামী লীগের বিপুল জয় হয়েছে। সরকার গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। এখানেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মধ্যে ধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি কখনো বলছেন না যে তিন মাস কিংবা এক বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই কেউ কেউ সময় উল্লেখ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছেন। আমার ব্যক্তিগত মত, এ ধরনের মন্তব্য থেকে মন্ত্রী-এমপিদের বিরত থাকা উচিত। না হলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। মানুষ ভাববে, প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সরকার দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করতে চায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। শুধু বিচারের জন্য বিচার করলে চলবে না, বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এর জন্য প্রয়োজন সময়ের এবং সঠিক তথ্য ও উপাত্তের সমাবেশ। ৪০ বছর আগেকার অপরাধের বিচার তাড়াহুড়া করে সম্পন্ন করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাও এ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি সচেতন এবং সম্পৃক্ত মানুষের কাজ হবে সরকারকে তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করা, না হলে আমরা গ্রহণযোগ্য বিচার পাব কি না সন্দেহ।
বাঙালি জাতি আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সব কিছু অর্জন করে। এ দেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশ গঠনে অবদান রাখছে। আমরা প্রতিটি বিপদ-আপদে যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে সংগ্রামী হতে হয়। তাঁর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ ৩৫ বছর বুকে কষ্ট লালন করেছেন। অবশেষে মা-বাবাসহ অন্যদের হত্যার বিচার পেয়েছেন। আমার বিশ্বাস শেখ হাসিনার মতো আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাসহ সাধারণ জনগণ ধৈর্য ধারণ করবেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা একদিন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেষ হবে। জাতি একদিন কলঙ্কমুক্ত হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটু ধৈর্য ধারণ করি।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.