তদন্ত-বিচারব্যবস্থায় ডিএনএ প্রযুক্তি দরকার by আবুল হাসনাত ও শরীফ আখতারুজ্জামান

বিচারব্যবস্থায় বিজ্ঞানের ব্যবহার নতুন নয়। যদিও ১২৪৮ সাল থেকেই বিজ্ঞানকে বিচারব্যবস্থায় ব্যবহারের চেষ্টা চলে আসছে, প্রাচীনকালে এমনকি বর্তমানেও অধিকাংশ দেশে বিচারকার্য সম্পন্ন করা হয় সাক্ষী ও স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে। যতই বিজ্ঞানের অগ্রগতি হচ্ছে, ততই বিচারকার্যে ব্যবহারের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হচ্ছে। অপরাধ তদন্তে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন: রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যবহারকে ফরেনসিক বিজ্ঞান


বলা হয়। ১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার অ্যালেস জেফরিস প্রথম আবিষ্কার করেন যে মানুষের ডিএনএতে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যার ওপর ভিত্তি করে একজন মানুষকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব। এ কাজে যে প্রযুক্তি তিনি প্রথম ব্যবহার করেন, একে বলা হয়েছিল ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং, যা বর্তমান বিশ্বে ডিএনএ প্রোফাইলিং নামে সর্বাধিক পরিচিত। ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিংকে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে একজন ব্যক্তির জেনেটিক ফটোগ্রাফ।
১৯৩০ সাল থেকে তদন্তপ্রক্রিয়ায় মানুষকে শনাক্ত করার জন্য আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহূত হচ্ছে। প্রত্যেক মানুষের আঙুলের ছাপ নির্দিষ্ট বলে অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। তেমনই প্রত্যেক মানুষের ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিংও অন্য কারও সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল ফলাফল বা নিরপরাধ ব্যক্তির শাস্তি হওয়ায় আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। কেউ ইচ্ছা করলে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট বদলে ফেলতে পারে; কিন্তু এমন কোনো প্রযুক্তি নেই যার মাধ্যমে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট বদলে ফেলা সম্ভব। কারণ, মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষের অভ্যন্তরে অবস্থিত ডিএনএ এক ও অভিন্ন। সুতরাং, শরীরের যেকোনো ধরনের নমুনা—যেমন: রক্ত, লালা, সিমেন, চুল, ত্বক, হাড় ইত্যাদি—থেকে ডিএনএর মাধ্যমে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরি করা যেতে পারে। এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও আদালতের পক্ষে অনেক জটিল অপরাধের কারণ বের করা সম্ভব। বিশেষ করে হত্যা, ধর্ষণ, পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নির্ধারণ এবং মৃত ব্যক্তির পরিচয় নির্ণয়ে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং প্রযুক্তি অব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য মানুষের শরীরের কোন জৈবিক নমুনা (Biological Sample) ব্যবহার করবে, তা নির্ভর করে নমুনার প্রাপ্যতার ওপর। যেমন, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সময় সাধারণত আহত বা মৃত ব্যক্তি সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে। এ কারণে অপরাধীও কিছুটা জখম হতে পারে। অপরাধীর রক্ত মৃত ব্যক্তির কাপড়-চোপড়ে লাগতে পারে অথবা ওই ব্যক্তির হাত ও নখের মধ্যে খুনির চুল বা ত্বকের কোষ থেকে যেতে পারে; অথবা খুনি কোনো নমুনা বা তার ব্যবহূত কোনো জিনিস অসাবধানতাবশত ফেলে যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে কাপড়, চুল বা ত্বক থেকে প্রাপ্ত ডিএনএকে সন্দেহজনক ব্যক্তির রক্তের ডিএনএর সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যাবে সন্দেহজনক ব্যক্তিটি প্রকৃত খুনি কি না। কারণ, ওই ব্যক্তি খুনি হলে দুটি ডিএনএ এক হবে। অনুরূপভাবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধী নিশ্চিতভাবে রেখে যাচ্ছে শুক্রাণু (Vaginal swab)। তা থেকে খুব সহজেই শুক্রাণু আলাদা করে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি সম্ভব। এই ডিএনএ প্রোফাইল যে অভিযুক্ত ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে মিলে যাবে, সে-ই হলো প্রকৃত ধর্ষণকারী।
পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মা-বাবা ও শিশুর ডিএনএ প্রোফাইল পরীক্ষা করে প্রকৃত মা-বাবা নির্ণয় সম্ভব। (বিস্তারিত পদ্ধতি বর্ণনা করছি না)। একইভাবে ইমিগ্রেশন বিতর্ক, উত্তরাধিকার বিতর্ক, দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তকরণেও এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
২০০২ সালে চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জামালউদ্দিনের অপহরণ ও হত্যা এ দেশের সুশীল সমাজ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নাড়া দিয়েছিল। অপহরণের সঙ্গে জড়িত একজনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী চট্টগ্রামের গহিন পার্বত্য এলাকার কবর থেকে দেহাবশেষ উদ্ধার করে একটি দাঁত ও হাড় ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। ওই নমুনা জামালউদ্দিনের কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁর স্ত্রী ও ছেলের রক্তের নমুনা সিঙ্গাপুরের একই পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। তিনজনের ডিএনএ প্রোফাইল পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় যে ওই কঙ্কাল জামালউদ্দিনের।
বাংলাদেশেও ২০০৬ সালে ডানিডার (DANIDA) সহযোগিতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একটি ডিএনএ ল্যাবরেটরি চালু করা হয়েছে এবং এটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ডিএনএ প্রোফাইল পরীক্ষা করে আসছে। ধর্ষণ, খুন, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব নির্ণয়সহ প্রায় সব ধরনের ডিএনএ পরীক্ষাই এখানে করা হয়।
পাঠকদের সুবিধার্থে দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৯৮ সালে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বিরুদ্ধে"মনিকা লিউনিস্কি নামের এক তরুণী সহকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ক্লিনটন জনসমক্ষে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। দাবির সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এফবিআই হোয়াইট হাউজ থেকে প্রেসিডেন্টের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে। পরবর্তী সময়ে ওই মনিকার পোশাকে উপস্থিত সিমেন ও প্রেসিডেন্টের রক্তের ডিএনএ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় যে দুটি নমুনার উৎস একই অর্থাৎ ওই সিমেন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের। ক্লিনটন শেষ পর্যন্ত ক্ষমা প্রর্থনা করে ইম্পিচমেন্ট থেকে রক্ষা পান।
২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার সিআইডির (CID) অধীনে আরও একটি ডিএনএ ল্যাবরেটরি চালুর প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। জাপান সরকার এ কাজে প্রায় ২০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। এটি চালু হলে জটিল ও চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে সবার ধারণা। বাংলাদেশে বর্তমানে বিচারব্যবস্থা পুরোটাই সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। অনেকে নিরাপত্তার অজুহাতে আদালতে উপস্থিত হতে ভয় পায়। এ কারণে অনেক দাগি আসামিও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। এ ধরনের ডিএনএ ল্যাবরেটরি বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা স্থাপনে সহযোগিতা করবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
ড. আবুল হাসনাত: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ahasnat99@yahoo.com
ড. শরীফ আখতারুজ্জামান: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.