চরাচর-শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শান্তিলতা সাহা

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিতি ছিল। কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়ে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। কলেজজীবনেই তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তার উন্মেষ ঘটে। সময়টিও তখন গণ-আন্দোলনের কাল। আকাশে-বাতাসে মুক্তির স্লোগান। আসাদের আত্মাহুতি সব বাঙালিকে নাড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করে তোলে। দেশমাতৃকার প্রতি অপার ভালোবাসা


এবং একজন মানুষ হিসেবে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বজনরা দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে গেলেও তিনি রয়ে যান। তিনি নারীদের সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। কিন্তু তিনি স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। দীর্ঘ এক মাসের মতো সময় তাঁকে বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে পাষণ্ডরা বাংলা মায়ের এই বীর সন্তানকে হত্যা করে। বাবাকে সহায়তা করার মানসে এইচএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি আলকা মিলনী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। কলেজে ভর্তি হলেও তিনি স্কুলের ক্লাস যেমন নিতেন, তেমনি কলেজের ক্লাসেও নিজে যোগ দিতেন। স্কুলের শিক্ষক তথা সহকর্মীদের অতি প্রিয় হওয়ায় স্কুলের রুটিনটি তাঁর নিজের ক্লাস রুটিনের সঙ্গে সমন্বয় করে নিতেন। এভাবেই চলছিল। শান্তিলতা এসএসসি পাস করেন ১৯৬৭ সালে। এর দুই বছর পর ১৯৬৯ সালে তিনি এইসএসসি উত্তীর্ণ হন। তাঁর খুড়তুতো ভাই বিষ্ণুপদ সাহার (তিনি শান্তিলতার চেয়ে এক বছরের বড়) বক্তব্য : 'কলেজজীবনেই তার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা প্রস্ফুটিত হয়। তবে আমরা তা বুঝতে পারিনি। সে যে তার রাজনৈতিক আদর্শে অবিচল এবং আস্থাশীল ছিল, সেটা তার পরবর্তী কার্যক্রমে প্রমাণিত হয়েছে।' যতদূর জানা যায়, তিনি কলেজজীবনেই মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আদর্শকে আঁকড়ে ধরেন এবং নিজেকে এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। তিনি নারীদের মধ্যে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বে ফুলতলাসহ আশপাশের এলাকায় রাজাকার তথা অত্যাচারী গোষ্ঠী হিসেবে সরো মোল্লা এবং তার অনুসারীদের নাম বারবার উচ্চারিত হয়। ওই বাহিনীর নামে গোটা অঞ্চলটি তখন প্রকম্পিত ছিল। রফির নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এই রাজাকার তথা সরো বাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে প্রতিহত করে। একপর্যায়ে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পিপরাইল গ্রাম আক্রমণ করে শান্তিলতাকে ধরে ফেলে। সেখান থেকে তাঁকে খুলনা শহরের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। প্রায় মাসখানেক তাঁকে এখানে-সেখানে রেখে নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করে। একপর্যায়ে গল্লামারী বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁকে দিয়ে পাকিস্তানের প্রতি অখণ্ডতা এবং তাঁর আস্থাসূচক বক্তব্য প্রচার করা হয়। পরে তাঁকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয় গল্লামারী বধ্যভূমিতে। এ ব্যাপারে রফির অনুজ শেখ রোকনউদ্দিন বলেন, 'শান্তিলতাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা তাঁকে উদ্ধারের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করি। রফি ভাই একাধিকবার তাঁর বাহিনী নিয়ে ওই রাজাকারদের আক্রমণ করে। একপর্যায়ে তিনিই রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকেও ওরা হত্যা করে তাঁর মাথা এই ফুলতলা বাজারে ঝুলিয়ে রাখে। আমরা শান্তিলতাকে উদ্ধারে ব্যর্থ হই। তাঁকে হত্যা করে গল্লামারীতে তাঁর মৃতদেহ ফেলে রাখার বিষয়টি আমাদের সহযোদ্ধাদের দ্বারা নিশ্চিত হয়েছিলাম।'
গৌরাঙ্গ নন্দী

No comments

Powered by Blogger.