শিবের গীত-ঢাকাদক্ষিণ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম


ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আমার বন্ধু পার্থপ্রতিম আমাকে তার গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের নাম ঢাকাদক্ষিণ—সিলেট শহরের কয়েক মাইল দূরে যার অবস্থান, এবং শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থান বলে অনেকে, বিশেষ করে ঢাকাদক্ষিণবাসী, বিশ্বাস করায় যার মর্যাদা একটা তীর্থস্থানের। পার্থপ্রতিমের ইতিহাসজ্ঞান যে খুব প্রবল ছিল, তা নয়—সে বিশ্বাস করত, শের শাহ ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করার আগে ঘোড়ারা ডাকতে পারত না, অর্থাৎ তারা


হ্রেষাধ্বনি করতে অপারগ ছিল। সে তার বাড়ির পাশের এক মণ্ডপ দেখিয়ে ঘোষণা দিয়েছিল, ওই মণ্ডপেই শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছিল। মণ্ডপের একদিকে আমি সত্যি সত্যি অনেক পুরোনো ইটের একটি দেয়াল দেখেছিলাম, যার অর্ধেক ছিল মাটিতে। শ্রীচৈতন্যের কারণে পার্থপ্রতিমকে আমার সমীহের এবং কিছুটা ঈর্ষার পাত্র বলে মনে হতো। যদিও ওই মহাপুরুষ কোন বিশিষ্টতার দাবিদার, সে সম্পর্কে আমার তখন কোনো ধারণা ছিল না।
শ্রীচৈতন্যের চেয়ে আমার কাছে বরং অনেক কৌতূহলের পাত্র ছিলেন স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব, যার জন্মদিনের উৎসব হতো আমাদের সিলেটের বাড়ির পাশে মনিপুরি মণ্ডপে এবং যেখানে ভক্তরা তাঁর নানা বাণীসংবলিত হাতে লেখা পোস্টার টাঙ্গিয়ে দিতেন মণ্ডপের ভেতরে-বাইরে। এ রকম একটি বাণী ছিল, ‘জানি জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, তথাপি ছেলেরা জন্মোৎসব করে; বাধা দিই না, তাতে তারা আনন্দ পায়। আনন্দই ভগবানের স্বরূপ।’
পার্থপ্রতিমের গ্রামটাকেই একসময় আমার ঈর্ষা হতো। কী সুন্দর নাম, ঢাকার সঙ্গে কী মিষ্টি একটা সম্পর্ক, যদিও গ্রামটি আসলে ঢাকার উত্তর-পূর্বে। ভৌগোলিক এই বিভ্রান্তি মোচনের জন্য আমি নামের শেষে একটি একার যোগ করতে বলেছিলাম পার্থপ্রতিমকে, যাতে গ্রামটির সুদ্ধ নামকরণ হয় ‘ঢাকা দক্ষিণে’। কিন্তু সে রাজি হয়নি। ‘ঠাকুরের পদচিহ্ন-ধন্য গ্রাম, আমি কে যে এই নামেতে পরিবর্তন আনি?’ এই ছিল তার পরিষ্কার উত্তর।
ঢাকাদক্ষিণ নামটা আমাকে এমনই টানত যে একসময় ভেবেছি আমার গ্রাম বানিয়াচংয়ের নামটা বদলে ঢাকাদক্ষিণ অথবা ঢাকাদক্ষিণচং করে ফেলব। আমার ইতিহাস পাঠ আমাকে জানিয়েছিল আমাদের গ্রাম অথবা মহকুমার সঙ্গে সিদ্ধপুরুষ নাসিরউদ্দিন সিপাহসালারের সম্পর্ক ছিল; তিনি এ অঞ্চলেই স্থায়ীভাবে থেকে যান। কিন্তু আমার প্রস্তাবে কেউ সামান্যতম আগ্রহ না দেখানোয় ঢাকা দক্ষিণবাসী হওয়ার স্বপ্ন আমার অপূর্ণই রয়ে যায়।
অপূর্ণ রয়ে যায়, অর্থাৎ মাত্র ৫০ বছর। কারণ, ২০১১ সালের এক শুভদিনে সেই স্বপ্নটি, যাকে বলে আমার আঁখি পাতে এসে ধরা দিল। জাতীয় সংসদে মাত্র চার মিনিটে সরকার বাহাদুর ঢাকাকে উত্তর-দক্ষিণে বিভাজিত করে আমার স্বপ্নের একটি বাস্তব ভিত্তি দিল। এই চার মিনিটের ব্যাপারটা নিয়ে সমালোচনা হতে দেখেছি—কেন এই অনাবশ্যক দ্রুতি, ইত্যাদি। কিন্তু একজন মানুষের স্বপ্ন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে না, স্বপ্নের স্থায়িত্ব, ফ্রয়েড সাহেবের মতে, যে মাত্র মিনিট কয়েকের, তা সমালোচকেরা জানেন না? আমি যে শেষ পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণবাসী হতে পেরেছি, তা কি সম্ভব হতো যদি এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা, গণভোট ইত্যাদি হতো? জগতে যা কিছু শুভ, সুন্দর, মঙ্গলময়, সবই তো চটজলদিই হয়। ‘আপনার মেয়ে হয়েছে’ অথবা ‘উড ইউ ম্যারি মি?’ অথবা ‘কাল থেকে চাকরিতে যোগ দেবেন’—এসব বলতে কতক্ষণ লাগে?
আমি সমালোচনা নিয়ে ভাবি না, আমি ভাবি ফল নিয়ে। পার্থপ্রতিম আমেরিকায় থাকে। তাকে ই-মেইলে জানিয়েছি, আমিও এখন ঢাকা দক্ষিণবাসী।
সি.ক. প্রশাসক এখন ঢাকা দক্ষিণপিতা, জনগণের ভোটে পিতা না হয়েও। তাঁকে আমি আরও কিছু অনুরোধ জানাব, যেমন—উত্তরের মশা যেন দক্ষিণে না আসে; দক্ষিণের বাতাস উত্তরে গেলে সে জন্য উত্তরবাসী যেন যথাযথ ট্যাক্স দেয়, উত্তরের শিক্ষার্থীরা দক্ষিণের দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে যেন উচ্চতর হারে বেতন দেয়—এসব বিষয় নিয়ে তিনি যাতে উত্তর-দক্ষিণ সংলাপ শুরু করেন। সরকার বাহাদুর বলেছেন, দুই সি.ক. এখন এমন সেবা দেবে যে উত্তরে দুধের নহর বইলে, দক্ষিণে বইবে মধুর নহর। ‘তিলোত্তমা ঢাকা’ নামে যে বিদ্রূপাত্মক বর্ণনা ছিল একসময় শহরটির বিশেষ করে ‘ফুলের মতো পবিত্র’ চরিত্রের এক মেয়রের সময়, এখন দুই ঢাকা তাকে পরিহাস করে হবে তিলোত্তমাতমা। ঢাকা দক্ষিণবাসী হিসেবে আমি চাইব এই তিলোত্তমাতমা হবে ঢাকা দক্ষিণ; ঢাকোত্তর (ঢাকা+উত্তর) হবে তিলোত্তরাতমা।
সেবার প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ঢাকা দক্ষিণ ঘোষণার পর মশা নির্মূল হয়ে গেছে, ফুটপাতগুলো আবার মানুষের দখলে, পথঘাট ফাঁকা, রাস্তাঘাটে কোলাহল নেই, ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রাক যাচ্ছে না, যত্রতত্র পসরা বসিয়ে পথবণিকেরা ব্যবসা করছে না, বিদ্যুতের সমস্যা নেই, পানির সরবরাহও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি।
বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে যারা গেল ২১ ডিসেম্বর রাত দুটায় ঢাকা দক্ষিণের রাস্তায় বেরিয়েছেন তাঁদের জিজ্ঞাস করুন। তাঁদের নিশ্চয় এই উন্নত ছবিটি চোখে পড়েছে। তবে হোক না তা প্রচণ্ড শীতের রাত দুটার ছবি, অন্তত এক রাত-দুপুরের জন্যও তো ঢাকা দক্ষিণ আমাদের প্রায় তিলোত্তমাসুলভ একটি ছবি দিতে পেরেছে, ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা শীতজর্জর মানুষগুলোকে বাদ দিলে। তা-ই বা কম কী? মেয়র খোকা কি তা এই ১০ বছরে পেরেছেন, তাঁর সময়ে তো বরং যেখানে মশার ওষুধ দেওয়া হতো, মশারা সেখানে ছুটে যেত। সুগন্ধিযুক্ত পানির স্প্রেতে গোসল করতে কোন মশা না পছন্দ করে, বলুন? ঢাকা দক্ষিণ প্রশাসকের কাছে নিবেদন, সেবার মধুনদী বইয়ে দেওয়া পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বরের শীত রাত্রিটা অন্তত সারা বছর প্রলম্বিত করুন। রাস্তায় বেরিয়ে যেন মনে হয়, স্বাভাবিক হাঁটাচলার অধিকারটা অন্তত আছে। রাস্তা যে রাস্তা, মরণফাঁদ নয়, পরপারের ফেরিঘাট নয়—এ কথা তো বহুদিন ভুলেই আছি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.