আয়কর আইনের খসড়ায় বড় পরিবর্তন আসছে by জাহাঙ্গীর শাহ


প্রকাশিত প্রত্যক্ষ কর আইনের খসড়ায় আবারও ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। নতুন আইনের খসড়ায় অর্থ স্থানান্তর-প্রক্রিয়াকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে টাকা পাচার ঠেকাতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের খুব একটা পরিবর্তন না করেই গত জানুয়ারি মাসে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর আইনের খসড়াটি প্রকাশ করা হয়। তবে খসড়াটির বিভিন্ন দিক


নিয়ে খোদ এনবিআরের কর্মকর্তারাই বেশ আপত্তি তোলেন। এমন প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত খসড়া আইনটি আরও পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকাশিত খসড়ায় আরও পরিবর্তন আনতে কিছুদিন ধরে আয়কর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ধারাবাহিক বৈঠক করছেন। সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর আয়কর বিভাগে এ-সংক্রান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আগামী জুন মাসের আগেই আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে বিল আকারে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এনবিআরের সদস্য (আয়করনীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম প্রথম আলোকে জানান, আয়কর বিভাগ শুধু আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করে দেবে। আর আইনটি কার্যকর করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে রাজনৈতিক। ভারতে নতুন প্রস্তাবিত প্রত্যক্ষ কর আইন তিন বছর আগে লোকসভায় উঠেছে। এখনো পাস হয়নি।
আমিনুল করিমের মতে, নতুন আইনে অর্থ পাচার রোধকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কেননা, অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ করজালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এতে রাজস্ব ফাঁকি বাড়ছে।
তা ছাড়া আইনের খসড়াটির সঙ্গে বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই। তাই নতুন আয়কর আইন যুগোপযোগী করতে চূড়ান্ত খসড়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হবে।
জানা গেছে, খসড়ায় বেশ কিছু নতুন ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। অর্থ স্থানান্তর বা অর্থ পরিশোধের প্রক্রিয়াকে আয়কর আইনের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আনা হবে। যেমন: কোনো একটি আমদানি করা পণ্যের দাম ১০ ডলার, কিন্তু মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ওই পণ্যের দাম ২০ ডলার পরিশোধ করা হলো। বাড়তি ১০ ডলার বিদেশে পাচার হচ্ছে। এ ধরনের অর্থ স্থানান্তর বা অর্থ পরিশোধকে আয়কর আইনের আওতায় নজরদারিতে আনা হবে।
এ ছাড়া যেকোনো ধরনের অর্থ স্থানান্তর বা পরিশোধকে আরও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় আনার পাশাপাশি আইনি-প্রক্রিয়া সুদৃঢ় করা হবে। এ ধরনের অর্থ পাচার কিংবা অবৈধ ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে জেল-জরিমানা তথা শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব করা হবে নতুন আইনে।
এদিকে ই-পেমেন্ট বা স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে অর্থ পরিশোধকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হচ্ছে। যখন আয়কর অধ্যাদেশ করা হয়, তখন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অর্থ পরিশোধের সুযোগ ছিল না। এখন ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
এসব প্রক্রিয়ায় যাতে কর ফাঁকি রোধ করা যায়, সে জন্য নতুন আইনের আলোকে একটি বিধিমালাও প্রণয়ন করা হবে।
এ ছাড়া নতুন আইনে চূড়ান্ত খসড়ায় সম্পদ করের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে প্রকৃত অর্থে সম্পদ কর আরোপের বিশেষ সুযোগ ছিল না। নতুন আইনে সম্পদ করকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হবে। কাদের ওপর সম্পদ কর আরোপ হবে, কী ধরনের সম্পদের ওপর আরোপ হবে এসব বিষয়ে সুম্পষ্ট উল্লেখ থাকবে।
জানা গেছে, নিজের বসবাস ব্যতীত বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট, পৌর এলাকার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত খামার, পৌর এলাকার জমি, গাড়ি, হেলিকপ্টার ও এয়ারক্রাফট, দামি অলংকার, নৃ-তাত্ত্বিক নিদর্শন, চিত্র, ভাস্কর্য ও দেশের বাইরে কোনো ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত থাকলে সম্পদ করের আওতায় আনা হচ্ছে। এমনকি ৫০ হাজার টাকার বেশি দামি ঘড়ি ব্যবহার করলেও কর দিতে হবে।
তবে কোনো করদাতা যদি কোনো বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টে বছরের ৩০০ দিনের কম বসবাস করেন, তাহলে তাঁকে ওই বাড়ির ওপর সম্পদ কর থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়। বাণিজিক উদ্দেশ্যে নির্মিত ভবনও সম্পদ কর থেকে অব্যাহতি পাবে। এগুলোর পাশাপাশি কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ করতে নানা উদ্যোগ থাকছে নতুন আইনে।
প্রকাশিত খসড়ায় যা আছে: সম্পদ কর, ভ্রমণ কর ও দান করকে আয়কর আইনের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এত দিন ভ্রমণ কর অর্থ বিলের সঙ্গে প্রতিবছর অন্তর্ভুক্ত করা হতো।
আয়কর আইনের খসড়ায় যেকোনো ধরনের দানের ওপর করারোপের বিধান রাখা হয়েছে। শুধু রাষ্ট্র ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দান করের আওতামুক্ত থাকবে। এ ছাড়া বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার কর্তৃক অনুমোদিত দান, ধর্মীয় উপাসনালয়ে দান, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান করের আওতায় থাকবে না।
তবে স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, মা-বাবা, ভাই-বোন ছাড়া অন্য যেকোনো আত্মীয়স্বজনকে দান করলে তা করের আওতায় পড়বে।
খসড়ায় ভুয়া টিআইএনধারীকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো করদাতার কাছে টিআইএন চাওয়া হলে তা প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। নির্ধারিত সময় আয়কর প্রদানে ব্যর্থ হলে করদাতাকে পাঁচ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.