নিত্যজাতম্‌-এ জীবন বাড়িওয়ালার জন্য উৎসর্গ by মহসীন হাবিব

সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর ঢাকা শহরে বাণিজ্যিক কারণে গড়ে ওঠা একটি কবুতরের খোঁপে মাথা গুঁজে দিতে হয়। আপনি ঢাকা শহরের সব ধুলা-ধোঁয়া শরীরে মেখে ঘরে ফিরছেন। ঘরে ঢুকেই আপনাকে স্ত্রী বা সন্তানদের মুখে হয়তো শুনতে হবে_গ্যাস টিমটিম করে জ্বলছে, রান্না করা যাচ্ছে না। অথবা আপনাকে শুনতে হবে, বেসিনের কলটা নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালাকে খবর দিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, ঠিক করে নিন। সাপ্লাইয়ের পানি আসছে না,


এটি বাড়িওয়ালার মাথাব্যথা নয়। রাত ১১টা অথবা ১২টার মধ্যে আপনাকে ঘরে ফিরতে হবে। ওই সময়ের মধ্যে আপনাকে পরিবারসহ তালা দেওয়া হবে। আসলে আপনি থাকছেন একটি প্রিজন সেলে। সকালে আপনাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়, আবার রাতে জেল। এভাবেই ঢাকা শহরে কাটছে আপনার দিন। মেনে নিয়েছেন এ জীবন। কিন্তু যা সহ্যের বাইরে চলে গেছে তা হলো, মাস শেষে বাড়িওয়ালার বাড়িয়ে দেওয়া হাত। সেই হাতের দাবি এখন এতটা বেড়েছে যে তা পরিষ্কার নির্যাতনের পর্যায়ে চলে গেছে। বাড়িওয়ালার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আপনাকে সর্বদা বলে দিচ্ছে, থাকবেন না, চলে যান। আপনি চলে গেলেই তো দুই হাজার টাকা আরো বাড়াতে পারি। কিন্তু আপনি যাবেন কোথায়? ওই বাড়িটি ছাড়লেই আরেকটি একই আয়তনের বাড়িতে উঠতে আপনাকে আরো দুই হাজার টাকা বেশি গুনতে হবে। আগে বাড়ত ৫০০ টাকা, এখন বাড়ে দুই হাজার টাকা হারে। তাই আপনার চোখে-মুখে বিনয়ের ভাব। একরকম যেন দয়ার ওপর আপনি বাড়িটিতে আছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের চার্ট অনুসারে একটি ৮৫০ বর্গফুটের বাসার ভাড়া হওয়ার কথা পাঁচ হাজার ৫২৫ টাকা। কিন্তু এ আয়তনের কোনো বাসা আপনি ঢাকা শহরের কোথাও ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার নিচে পাচ্ছেন না। জিজ্ঞেস করি, এ কি অনিয়ম, না ডাকাতি! এ নির্যাতন আপনাকে কেন সহ্য করতে হচ্ছে?
এই ঢাকা শহরে আপনার যাবতীয় খরচের চেয়ে বেশি টাকা বাড়িওয়ালার হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, কেউ কেউ বেতনের পুরো টাকা বাড়িওয়ালার হাতে তুলে দিচ্ছেন। যেন এ জীবন, এ চাকরি_সব কিছু বাড়িওয়ালার ভাড়া জোগানোর জন্যই। আপনি শুধু কোনো রকম বেঁচে থাকবেন। আপনার যদি ঘুষ, চুরি, রাহাজানি (চুরি-রাহাজানি বলতে রাস্তার ছিঁচকে চুরি-রাহাজানি নয়, অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চুরি-রাহাজানি) ও ছিনতাইয়ের অর্থ না হয়ে থাকে, তাহলে আপনি বুঝতে পারছেন কী নিষ্ঠুর হাতে পিষে আপনার জীবন, আপনার আয়ের ভাগ কেড়ে নিচ্ছে এই বাড়িওয়ালারা। এভাবেই ঢাকা শহরে লাখ লাখ মানুষ ব্ল্যাকমেইল হচ্ছে লাখো বাড়িওয়ালা দ্বারা।
আপনার বাড়িওয়ালার ছেলেটি অবশ্যই বেকার অথবা নামকাওয়াস্তে কোনো ইংরেজি নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র (অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে, শুধু সাধারণ চিত্রটির কথাই বলছি)। সকালে একটি মোটরসাইকেল টেনে নিয়ে বের হচ্ছে, বিকেলে একটি প্রাইভেট কার গ্যারেজ থেকে নিয়ে বের হচ্ছে। বাড়িওয়ালা ধোলাই করা পাঞ্জাবি পরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চেহারা নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করছেন। নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য কাজটি করতে তিনি অবশ্য ভুল করছেন না। সকালে অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বাজারটা নিজের হাতে করছেন। কিছু সাগরেদ টাইপের স্বল্প আয়ের মানুষ আছে তাঁর আশপাশে। তাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন। এর পেছনের আসল কথা হলো, তিনি একজন বেকার মানুষ। কোনো দিনও কোনো কাজ ছিল না তাঁর, এখনো নেই। এই জীবন যাপনের পয়সা জোগাচ্ছেন আপনি। সারা জীবন আপনার মতো কেউ না কেউ এ পয়সা জোগাবে। সৌদি আরবের মানুষদের যেমন আল্লাহর দান তেল আছে, তেমনি বাড়িওয়ালার আছে একটি চার বা পাঁচতলা বাড়ি এবং অধিকাংশ বাড়ির কোনো না কোনো আইনগত ত্রুটি আছেই। কোনোটির রাজউকের সঠিক পারমিশন নেই, কোনোটি অন্যের বা সরকারের জায়গার মধ্যে ঢুকে পড়েছে দুই হাত। শুনলে অবাক হবেন, কোনো কোনোটির দলিল পুরোপুরি জাল। কিন্তু অবলীলায় তুলে ফেলা হয়েছে একটি পাঁচতলা বাড়ি। মাসে আয় তিন লাখ টাকা। কারো কিছু করার নেই। যারা এসব অনিয়ম দেখবেন সেই সরকারি অফিস-আদালতের লোকদের মাথা কিনতে এখন খুব বেশি অর্থ লাগে না। লক্ষ করে দেখুন, এ দেশের কোনো কোটিপতি জেলখানায় নেই। আইন এ দেশে দরিদ্র-অসহায় মানুষদের নিয়ন্ত্রণের জন্য। অস্বীকার করছি না, বাড়িটি তুলতে তাঁর কোটি টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। জমিটি যদি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া না হয়, তাহলে কিনতে অনেক টাকা বের হয়ে গেছে। (অবশ্য টাকাটা পেয়েছেন কোথায়, সেটা পরের বিবেচনা)।
থুক্কু (এটি ফরিদপুর অঞ্চলের ভাষা। ছেলেমেয়েরা খেলতে গিয়ে কোনো ভুল করে ফেললে অপর পক্ষ ধরে ফেলার আগেই যদি থুক্কু বলা যায়, তাহলে আবার খেলাটি শুরু করার অধিকার জন্মায়)। ভুল বলেছি। সব বাড়িওয়ালা বেকার নন। ঢাকা শহরে বাড়িওয়ালাদের একটি বড় অংশ সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত, অথবা এখনো চাকরিরত। তিনি বাড়ি করেছেন স্ত্রীর নামে। অথবা শ্যালক বা অন্য কারো নামে। এসবও যাঁদের দেখার কথা তাঁরা দেখছেন না। ঠুঁটো জগন্নাথ একটি দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে দেশে। না সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে দাঁড়াতে দিল, না তারা নিজেরা শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। এসব ভিন্ন আলোচনা। আপাতত বাড়ি ভাড়ার যন্ত্রণার মধ্যেই থাকি। (নতুন প্রজন্মের যে পাঠকরা এ নিবন্ধ পড়বেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ঢাকা শহরে বাবার তৈরি করা বাড়িতে আছেন। যদি আপনার বাবা একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে থাকেন, তাহলে একটিবার আপনার বাবার মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখুন তো, তিনি আসলে কে)?
বিনা ভাড়ায় এ শহরে কেউ থাকার আশাও করেন না। কিন্তু সব কিছুর একটি সীমা আছে। দেশে সরকার নামের একটি অভিভাবক রয়েছে অনিয়ম-অবিচার দূর করার জন্য। অভিভাবক তার দায়িত্ব কোনো দিন পালন করেনি, আজও করছে না। দেড় কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ হয় বাসা ভাড়া করে থাকেন অথবা বস্তিতে মুখ গুঁজে আছেন। দেশে হাউস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট-১৯৯১ চালু আছে। এমন কোনো ভাড়া বাসা পাওয়া যাবে না, যে বাড়িতে এই অ্যাক্ট অনুসরণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে বা নেওয়া হয়েছে। ১৯৯১ সালের এই অ্যাক্টে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, বাসা ভাড়া পুনর্নির্ধারণ হবে দুই বছর পর পর। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সম্প্রতি বছর ঘুরতেই কমপক্ষে দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানোর 'নিয়ম' চালু করেছেন ভাগ্যবান ওই বাড়িওয়ালারা। কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ১৫ শতাংশ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাত্র তিন বছর আগে যে বাসাটির ভাড়া ছিল মাত্র তিন-চার হাজার টাকা, সেটির ভাড়া এখন ১২ হাজার টাকা। তার ওপর শুরু হয়েছে বাড়িওয়ালাদের নতুন বাহানা সার্ভিস চার্জ। কমপক্ষে এক হাজার থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও ১০ হাজার টাকাও সার্ভিস চার্জ দাবি করা হচ্ছে বা নেওয়া হচ্ছে। অবশ্য একটি শ্রেণীর এ রকম ভাড়া দিতে আপত্তি নেই। তাদের কথা, কত আর নেবে? মাত্র অল্প কয়েক বছরে গজিয়ে ওঠা একটি শ্রেণী ঢাকা শহরে টাকা উড়ে বেড়ায় বলে যে প্রবাদ আছে, সেই টাকা ধরে থাকেন। ধরা টাকা, ওই টাকার কোনো হিসাব থাকে না। আমার-আপনার মতো লাখ লাখ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার কথা তাঁরা জানেন না।
মাত্র এক হাজার বর্গফুটের একটি খুপরি ঘরের ভাড়া বাড়িওয়ালারা আদায় করছেন কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। কেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোন এলাকায় কত বর্গফুটের কত ভাড়া হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে জনগণকে গণমাধ্যমে জানাচ্ছে না? কেন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সরকার বাড়িওয়ালাদের এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে না? কারণ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যাঁরা দেশের এই শ্রমজীবী মানুষকে রক্ষা করবেন তাঁরা আসলে শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি নন, বাড়িওয়ালাদের প্রতিনিধি। নিবিড় তদন্ত করলে দেখা যাবে, দুই-চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া সব সরকারি কর্মকর্তার ঢাকায় অথবা অধুনা বর্ধিত ঢাকার কোথাও না কোথাও একটি সুপ্রশস্ত বাড়ি আছে। কিংবা বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। এমন সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাঁদের দামি গাড়ি আছে (কারো কারো একাধিক), যা অফিসের কেউ জানেন না।
আমরা বাড়িওয়ালি নামের একটি পেশার কথা আগে জানতাম। পেশাগত কারণে তাঁরা নিষ্ঠুর হতেন। তাঁদের কালচারের মধ্যেই নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান থাকতে দেখা গেছে। বর্তমান বাড়িওয়ালাদের বেলায়ও তা-ই দেখা যাচ্ছে। ভাড়াটে মানেই এক অসহায় মানুষ, অসহায় পরিবার। তাদের দেখার কেউ নেই। বাংলাদেশ অনিয়ম, অপরিপক্ব শাসন, আদর্শহীন সমাজব্যবস্থার কারণে একটি কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। এক শ্রেণী পশুর মতো গলা পেতে দিচ্ছে, আরেক শ্রেণী সেই গলায় নিষ্ঠুর ছুরি চালাচ্ছে। তাই অভিভাবক সরকারকে বলছি, যদি সত্যিকারার্থে সাধারণ মানুষের জন্য সামান্যতম দরদ থাকে, তাহলে এখনই এসব অনিয়ম দূর করা হোক। যে দেশের শ্রমজীবী মানুষ সচ্ছল থাকে, সে দেশকে কেউ ফেরাতে পারে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আদালতকে করতে দিন। দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষাই আদালতে প্রতিফলিত হবে আশা করি। আপনারা বঞ্চিত মানুষের জন্য যুদ্ধ করুন। এসব অন্যায়-অনিয়ম দূর করুন।
লেখক : সাংবাদিক
mohsinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.