স্বাস্থ্যসেবা-ভুল চিকিৎসায় বিপন্ন জীবন by মেহেরুননেছা


ভুল চিকিৎসার পরিণামের কথা এত দিন শুনে আসছিলাম, কিন্তু এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করছি আমি, আমার পরিবার। কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম, দুর্বিষহ এই অবস্থার কথা সবার সামনে তুলে ধরব, যদিও এভাবে মনের ক্ষোভ আর সার্বিক ক্ষতি কোনোভাবেই কমবে না বলে জানি। তার পরও আমাদের মতো যাঁরা এই পরিণতির শিকার, তাঁরা অন্তত আমাদের মনের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন। গত জুন মাসে টিউমার হওয়ায় ধানমন্ডির একটি হাসপাতালের


কিডনি বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে আমার এক আত্মীয়র একটা কিডনি অপসারণ করান। অপসারণ করা কিডনি বায়োপসি করে তাতে ক্যানসারের উপাদান পাওয়া যায়। চিকিৎসক শরীরের অন্য কোথাও ক্যানসার নেই বলে জানিয়ে দেন এবং তিন মাস পর নিয়মিত পরীক্ষা করার জন্য আসতে বলেন। সুস্থ শরীর নিয়ে যথাসময়ে ওই হাসপাতালে চেকআপ করে সব রিপোর্ট ভালো এলেও বুকের ইসিজিতে এল, ‘অনুমান করা যায় রেনাল সেল কার্সিনোমা’। রেফার করে দেওয়া হলো ধানমন্ডির আরেকটি হাসপাতালের একজন অধ্যাপকের কাছে। তিনি পূর্ববর্তী রিপোর্টের সঙ্গে রোগীর শরীরে ক্যানসারের কোনো রকম লক্ষণ খুঁজে না পেয়ে অবাক হন। এবং একটি এফএনএসি (FNaC fine needle afpiration, cytology) করাতে বলেন। ধানমন্ডির ওই হাসপাতালে করানো এফএনএসি রিপোর্টে এল, আমার ভগ্নিপতির একটি ফুসফুসের পুরোটাই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। চিকিৎসক দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে বলেন। রোগীর এবং আমাদের পরিবারের তখন কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আমার ভগ্নিপতি রিপোর্ট পাওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তখন আত্মীয়স্বজন যে যেভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ দেন, আমরা সেখানেই তাঁকে দেখাই এবং চিকিৎসকেরা পরামর্শ নিই।
শেষ পর্যন্ত ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজের ক্যানসার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলে তিনি কয়েকজন চিকিৎসক নিয়ে বোর্ড গঠনের মাধ্যমে ছয় মাস উচ্চমাত্রার একটি ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দেন, যা আমরা পাই শুধু ধানমন্ডির একটি ফার্মেসিতে। এখানে উল্লেখ না করে পারছি না যে, ওই ফার্মেসি থেকে এক পাতায় থাকা সাতটি ক্যাপসুল কিনতে হয়েছে ৮৭ হাজার টাকা দিয়ে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২১টি ক্যাপসুল (যার মোট মূল্য দুই লাখ ৬১ হাজার টাকা) কিনতে হয়েছে। ওষুধ চলাকালে শরীরে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হতে থাকলে রোগীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। এই অবস্থায় ১৫টি ক্যাপসুল খাওয়ার পর চিকিৎসক ওষুধ বন্ধ করে দিতে বলেন। তখন পর্যন্ত শরীরে ক্যানসারের কোনো লক্ষণ দেখা না দেওয়ায় আমরা এফএনএসি স্লাইড পুনরায় পরীক্ষা করার ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ চাইলে তিনি প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দেন। তার পরও নিজেদের দায়িত্বে এফএনএসির স্লাইড তুলে পুনরায় পরীক্ষা করার জন্য ধানমন্ডির একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জমা দিই। সেখান থেকে রিপোর্ট আসে, কোনো ক্যানসারের উপাদান নেই। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য স্লাইডটি আবারও পরীক্ষা করার জন্য মিরপুর ডেল্টা হাসপাতালে পাঠালে সেখান থেকেও কোনো ক্যানসার না থাকার রিপোর্ট প্রদান করা হয়।
এখানে আরেকটি বিষয় তুলে ধরতে চাইছি, ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার পর অবশিষ্ট ছয়টি ক্যাপসুল ওই ফার্মেসিতে ফেরত দিতে গেলে কর্তৃপক্ষ ফেরত নিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। তারা জানায়, এক পাতায় থাকা সাতটি ক্যাপসুল ছাড়া বিক্রি করা হয় না। অনেক অনুরোধের পর তারা এই শর্তে ওষুধটি রাখে যে যদি কেউ এক পাতা ছাড়া ক্যাপসুল কিনতে চায়, তাহলে তা বিক্রির পর আমাকে কেনা দামের চেয়ে কম টাকা ফেরত দেবে। যদিও অদ্যাবধি তারা আমার টাকা ফেরত দেয়নি, কবে দেবে, তা-ও জানি না।
ক্যানসারে আক্রান্ত না হয়েও শুধু রিপোর্টের ভুলের কারণে ক্যানসারের চিকিৎসায় উচ্চমাত্রার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রোগীর অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে রোগীর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও বিপর্যস্ত হয়ে গেছে পুরো পরিবার।
আমাদের দেশে এখানে-সেখানে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রচুর ডায়াগনস্টিক সেন্টার, যেগুলোর অনেকগুলোতেই রয়েছে অপ্রশিক্ষিত ও দায়িত্বহীন জনবল এবং অনুন্নত উপকরণ। আর তাদের ভুলের কারণে এ দেশের অসংখ্য মানুষকে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এমনকি জীবন দিয়েও খেসারত দিতে হচ্ছে, যে কারণে অনেকেই এখন আর আস্থা রাখতে পারছে না দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর। সঠিক চিকিৎসার জন্য তাই পাড়ি জমাচ্ছে দেশের বাইরে। যদিও তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে এসব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা কী করছেন? তাঁরা রোগীর চিকিৎসা না করে যেকোনো অজুহাতে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। চিকিৎসার নামে মানুষের জীবন নিয়ে এ ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হোক।
মেহেরুননেছা: বেসরকারি সংস্থার কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.