নতুন নম্বরপ্লেট-সনদ নিতে হবে সব মোটরযানকে by শরিফুজ্জামান ও আনোয়ার হোসেন

মোটরসাইকেলসহ সব শ্রেণীর মোটরগাড়ির জন্য নতুন প্রযুক্তির নম্বরপ্লেট, নিরাপত্তা ট্যাগ ও আধুনিক নিবন্ধন সনদ চালু করা হয়েছে। এ জন্য শ্রেণীভেদে গ্রাহকদের দুই হাজার ২০০ টাকা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে। সঙ্গে আছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট।


এই নতুন প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে রেট্রো-রিফ্লেক্টিভ নম্বরপ্লেট, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) ট্যাগ এবং স্মার্ট রেজিস্ট্রেশন কার্ড বা ভেহিকল ওনারশিপ কার্ড।
বর্তমানে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ যানবাহন আছে। ভবিষ্যতে আরও যেসব যানবাহন নামবে, সেগুলোর জন্যও এই নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এখন প্রতি মাসে সারা দেশে গড়ে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার যানবাহন নতুন করে নিবন্ধন নিচ্ছে। এই নম্বরপ্লেট, ট্যাগ ও নিবন্ধন সনদের মেয়াদ সাত বছর। অর্থাৎ সাত বছর পরপর এগুলো নতুন করে নিতে হবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ভেঙে গেলে বা নষ্ট হলে আবার নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তা সংযোজন করতে হবে।
যানবাহনে এ পদ্ধতি সংযোজনে গত ৩১ মে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সঙ্গে ৬০০ কোটি টাকার চুক্তি করেছে। বিএমটিএফকে বিপুল অঙ্কের টাকার এ কাজ দেওয়া হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই।
নম্বরপ্লেট সংযোজনের কাজ গতকাল থেকে শুরু হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন ৩১ অক্টোবর।
নতুন পদ্ধতি কেন: যানবাহন মালিকদের এই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করার পেছনে বেশ কিছু কারণের কথা বলছে বিআরটিএ। যেমন প্রচলিত নম্বরপ্লেটের আকার, সংখ্যা, অক্ষরের উচ্চতা ও যতটুকু ফাঁকা জায়গা রাখার কথা, তা মানা হয় না। ফলে রাস্তায় বিভিন্ন ভাষার, আকারের ও নকশার নম্বরপ্লেট দেখা যায়, যা দৃষ্টিকটু ও মোটরযান বিধির পরিপন্থী। এ ছাড়া প্রচলিত নম্বরপ্লেটে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় একই নম্বরপ্লেট বিভিন্ন গাড়িতে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভুয়া নম্বরপ্লেট ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
নতুন নম্বরপ্লেটে বিশেষ ধরনের স্ক্রু ব্যবহার করা হবে, যা একবার খুললে ভেঙে ফেলতে হয়। ফলে এক যানবাহনের নম্বরপ্লেট অন্য যানবাহনে লাগানো যাবে না। এ ছাড়া এখন মোটরযানসংক্রান্ত শক্তিশালী ডেটাবেজের আওতায় আন্তর্জাতিক মানসম্মত নিবন্ধন সনদ দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে কর, ফিটনেস (চলাচলের উপযুক্ততা), রুট পারমিটের (চলাচলের অনুমতি) মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মোটরযানের মালিক এসএমএসের মাধ্যমে হালনাগাদ করার তাগিদ পেয়ে যাবেন।
কোন যানবাহনে কত ব্যয়: বিআরটিএ নম্বরপ্লেট ও আরএফআইডি ট্যাগ সংযোজন বাধ্যতামূলক করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভাড়ায় চালিত এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারের বাস, ট্রাক, মিনিবাস, ট্যাংকলরিসহ ভারী যানবাহন এবং হালকা ও মধ্যম মানের মোটরযানের (কার, জিপ, ট্যাক্সি, পিকআপ ইত্যাদি) আরএফআইডি ট্যাগসহ এক জোড়া নম্বরপ্লেটের জন্য সাড়ে চার হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে।
গত জুন পর্যন্ত দেশে এই শ্রেণীর যানবাহন আছে পাঁচ লাখ নয় হাজার ৪১টি।
মোটরসাইকেল এবং সব ধরনের তিন চাকার যানের (অটোরিকশা, টেম্পো, মিশুক ইত্যাদি) নম্বরপ্লেট ও ট্যাগের জন্য দিতে হবে দুই হাজার ২০০ টাকা করে।
গত জুন পর্যন্ত দেশে মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে নয় লাখ ৪৯ হাজার ৪৭টি। এর বাইরে হাজার হাজার মোটরসাইকেল গ্রামেগঞ্জে নিবন্ধন ছাড়াই চলছে। সারা দেশে তিন চাকার যানের সংখ্যা দুই লাখ নয় হাজার ৩২২টি। অবশ্য এর বাইরে দেশে অন্যান্য শ্রেণীর যানবাহন রয়েছে ৮৪ হাজার ৪২৪টি।
যেভাবে বিএমটিএফকে নিয়োগ দেওয়া হয়: বিএমটিএফ প্রথম এ ধরনের কাজ পেল। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের দাবি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ কাজ সম্পন্ন করা হলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এ জন্যই সেনাবাহিনী-নিয়ন্ত্রণাধীন বিএমটিএফকে এ কাজ দেওয়া হয়েছে। তবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এ কাজ দেওয়া হলে গ্রাহকেরা আরও কম টাকায় এই সেবা পেতেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, এত বড় কাজ সময়মতো ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বিএমটিএফকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে করতে গেলে সময় বেশি লাগত এবং পুরো বিষয়টি ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ক্রয়সংক্রান্ত বিধিমালার (পিপিআর-২০০৮) ৭৬, এর ১(ক) এবং (ছ) ধারা মতে, বিএমটিএফকে এই কাজ দেওয়া হয়েছে। ৭৬, এর ১(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ক্রয়কারী কেবল একজন সরবরাহকারী বা ঠিকাদারকে দরপত্র দাখিলের জন্য আহ্বান জানাইতে পারিবে যদি পেটেন্ট, ব্যবসায়িক গোপনীয়তা এবং একক স্বত্বাধিকারের কারণে একই ধরনের পণ্য প্রস্তুতকরণে অন্যদেরকে নিবৃত্ত রাখা হয়, সেইক্ষেত্রে একক স্বত্বাধিকারভুক্ত পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা কেবলমাত্র একক স্বত্বাধিকারীর নিকট হইতেই ক্রয় করা যাবে।’
৭৬, এর ১(ছ) ধারায় বলা আছে, ‘বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি মালিকানাধীন শিল্প ও কারখানা হইতে সরকারের নিজস্ব অর্থে পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয় করা যাবে।’
অবশ্য সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় কারিগরি ইউনিটের (সিপিটিইউ) একজন কর্মকর্তা বলেন, বিআরটিএর সঙ্গে বিএমটিএফের চুক্তিটি পিপিআরের আওতায় পড়ে না। কারণ সরকারের বাজেট থেকে কোনো অর্থ ব্যয় করে পণ্য বা সেবা কিনলেই পিপিআর অনুসরণ করতে হয়। এখানে যানবাহন মালিকদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে সেবা দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএমটিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইফুর রহমান গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বিবেচনা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএমটিএফকে ‘ডিপোজিট ওয়ার্ক’ হিসেবে এ কাজ দেওয়া হয়েছে। যন্ত্রপাতি ক্রয়, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সেবা প্রদানের যত খরচ হবে, সবই বিএমটিএফ ব্যয় করবে। বিনিময়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হবে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে প্রস্তুতি প্রায় শেষ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রযুক্তি ও যন্ত্র আনা হয়েছে। নম্বরপ্লেট সংযোজনসহ যাবতীয় সেবা দিতে ঢাকায় প্রাথমিকভাবে ১২টি স্টেশন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নম্বরপ্লেট কখন নিতে হবে: বিদ্যমান ১৭ লাখ যানবাহনের নম্বরপ্লেট সংযোজন করা হবে ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময়, ট্যাক্সটোকেন নবায়ন ও অন্য যেকোনো কর ও ফি জমা দেওয়ার সময়। নতুন যানবাহনের ক্ষেত্রে নিবন্ধন নেওয়ার সময় ডিজিটাল নম্বরপ্লেট ও আরএফআইডি ট্যাগ দেওয়া হবে।
মোটরযান কর ফি এখন ব্যাংকের মাধ্যমে নেওয়া হয়। আর এ কাজটি করে থাকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার সিস্টেম লিমিটেড (সিএনএস)। এখন থেকে নম্বরপ্লেট ও আরএফআইডি ট্যাগের জন্য অর্থ জমা নিচ্ছে সাউথইস্ট, ব্র্যাক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক।
টাকা নেওয়া শুরু: গতকাল থেকেই নম্বরপ্লেটের জন্য টাকা নেওয়া শুরু হয়েছে। এই বাড়তি টাকা ছাড়া কাউকে ফিটনেস সনদ, নিবন্ধন, মালিকানা বদলি করতে দেওয়া হচ্ছে না।
সিএনজিচালিত অটোরিকশার একজন মালিক মোশাররফ হোসেন জানান, তিনি গতকাল ফিটনেস সনদ নবায়ন করতে গিয়ে দেখেন, বাড়তি টাকা জমা দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্র্যাক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে বিআরটিএর ফি ও কর জমা দিতে হয়। বাড়তি টাকা দেওয়ার কথা শুনে কোনো ভুল হয়েছে কি না, তা জানার জন্য তিনি তিনটি ব্যাংকের শাখাতেই যান। কিন্তু সব ব্যাংকে একই অবস্থা দেখে বাড়তি টাকাই জমা দেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও এনা পরিবহনের স্বত্বাধিকারী খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রযুক্তিকে আমরা স্বাগত জানাই। এর মাধ্যমে যদি যানবাহন ছিনতাই কিংবা ডাকাতি বন্ধ হয়, সেটা ভালো। তবে এ জন্য এত টাকা ব্যয় করা যৌক্তিক কি না, সেটা নিয়ে আলোচনার দরকার ছিল।’
ঢাকা সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ বলেন, কয়েক দিন আগে আয়কর বেড়েছে আড়াই হাজার টাকা। এখন আবার নম্বরপ্লেটের জন্য দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। কোনোটাই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়নি, চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.