তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য- ডেসটিনির তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকার অনিয়ম

ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম করেছেন। এর মধ্যে এক হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা সরাসরি তছরুপ করা হয়েছে। বাকি দুই হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার লেনদেন অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক।


এই অর্থ কোথায় আছে, কেউ জানে না। এ জন্য নিবিড় তদন্ত দরকার।
সচিবালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন এ তথ্য জানান। ডেসটিনির অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন সচিব। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ কমিটি গঠন করা হয়। গত সোমবার ওই প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরের (রেজসকো) নিবন্ধককে প্রধান করে করা নয় সদস্যের কমিটি আট মাসের মাথায় প্রতিবেদন জমা দেয়।
বাণিজ্যসচিব সাংবাদিকদের জানান, ডেসটিনি গ্রুপের ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টির কোনো না কোনোভাবে কার্যক্রম আছে। বাকি ১৩টি প্রতিষ্ঠান নামকাওয়াস্তে। এর মধ্যে ডেসটিনি ২০০০-সহ ২৬ কোম্পানির মধ্যে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ৪৭৩ কোটি টাকার। ডেসটিনি মাল্টিপারপাসে অনিয়ম হয়েছে ৯৮২ কোটি টাকার। ২৬ কোম্পানির অস্বাভাবিক লেনদেন এক হাজার ২৮২ কোটি টাকার। আর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৬২ কোটি টাকার।
অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা কতটা গভীর, নিবিড় তদন্ত হলে তা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সচিব। তিনি বলেন, এদের কর্মকাণ্ড অনেকটা মাকড়সার জালের মতো। শিগগির ডেসটিনিতে সরকার থেকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে বলেও জানান বাণিজ্যসচিব। তিনি বলেন, আইনকানুন লঙ্ঘনের জন্য সাতটি সংস্থা যার যার দিক থেকে এখন দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
প্রশাসক কী করবেন জানতে চাইলে সচিব বলেন, ডেসটিনির দৃশ্যমান বিষয়গুলো চালু রাখবেন প্রশাসক। তবে কোনো অলীক বিষয় নিয়ে কাজ করবেন না। আর খেয়াল রাখবেন, কোনো সম্পত্তি যাতে কেউ বিক্রি করতে না পারে। কিছু মানুষের জীবিকা নির্বাহের বিষয় আছে এতে।
সচিব গোলাম হোসেন বলেন, ডেসটিনির বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। বিষয়টি এতটাই গুরুতর যে এটা অনেকটা জাতীয় সংকটের মতো। মাঠে-ঘাটে, যেখানে-সেখানে এর কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তিনি বলেন, এক গাছ তারা ১০০ জনের কাছে বিক্রি করেছে। কত জনের কাছ থেকে যে এভাবে টাকা নিয়েছে, আল্লাহই জানেন। জনগণ সরল বিশ্বাসে টাকা দিয়েছে। তারা বিক্রি করেছে অদ্ভুত অদ্ভুত সব পণ্য।
বাণিজ্যসচিব বলেন, আশ্চর্যজনক যে ডেসটিনির কোনো নিজস্ব পণ্য নেই। পরিচালকেরা কিছু পণ্য উৎপাদন করতেন। উচ্চ দামে সেগুলো বিপণন করা হতো। তারপর তাঁরা কমিশন ভাগাভাগি করতেন। যত নিচের লোক, তত কম কমিশন। সর্বস্বান্ত হওয়ারও শঙ্কা থাকে এতে।
কিছু সিদ্ধান্ত: সচিব সাংবাদিকদের জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। তার পরই কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ডেসটিনির কার্যক্রম দেখাশোনার জন্য শিগগির এক বা একাধিক প্রশাসক নিয়োগ করা হবে। প্রশাসকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিরীক্ষা কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করা হবে। প্রশাসক ব্যাংক হিসাব নিয়ন্ত্রণসহ ডেসটিনির দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। প্রশাসক ডেসটিনির কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে না আসা পর্যন্ত কাজ করবেন।
গোলাম হোসেন জানান, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোনো কোম্পানিকে দিয়ে ডেসটিনির সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড বিশদ নিরীক্ষা করা এবং একই নিরীক্ষা ফার্মকে দিয়ে ডেসটিনির সব প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ও দায়দেনার খতিয়ান তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আয়কর ফাঁকির বিষয়েও নিবিড় তদন্ত করা হবে বলে জানান তিনি।
সচিব জানান, ডেসটিনির কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে যে ভিন্ন ভিন্ন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে এবং কমিটিগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এখন থেকে সব ধরনের সুপারিশ বাস্তবায়ন ও তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার জন্য সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
অনিয়ম-দুর্নীতি: বাণিজ্যসচিব জানান, ডেসটিনি গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে বেশ কিছু অনিয়ম-দুর্নীতি খুঁজে বের করেছে তদন্ত কমিটি। ডেসটিনি পরিবারভুক্ত ২২ পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার নিজেদের মধ্যেই অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন। তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারকে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথ্য গোপনও করেছেন। শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও তাঁরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি।
চড়া সুদে অবৈধ ব্যাংকিং করেছে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। যে উদ্দেশ্যে কোম্পানি গঠন করা হয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপের অনেক কোম্পানি এর বাইরে অন্য কাজ করেছে।
ক্রমাগত লোকসানি প্রতিষ্ঠানে মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে তহবিল তছরুপ করেছেন পরিচালকেরা। তাঁদের ব্যাংক হিসাবে সমিতির অর্থ বেআইনিভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে।
একচেটিয়া পণ্যের বাজার সৃষ্টি করে তাঁরা চড়া মুনাফায় পণ্য বিপণন করেছেন। প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছেন। বৃক্ষরোপণের কথা বলে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে এসব অর্থের কোনো হদিস নেই।
কারা ব্যবস্থা নেবে: তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ডেসটিনির শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সাতটি সংস্থা ব্যবস্থা নেবে বলে জানান বাণিজ্যসচিব। এগুলো হচ্ছে: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রেজসকো।
দুদক এরই মধ্যে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ডেসটিনির ২২ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। গতকাল তিনজনকে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকিরা এখনো পলাতক। ১১০ কোটি টাকা আয়কর ফাঁকির কথা এনবিআর চিহ্নিত করলেও তা এখনো আদায় করতে পারেনি। রেজসকো নিবন্ধন বাতিলের জন্য আদালতে আবেদন করার প্রস্তুতি নিয়েও পরে পিছিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক খুঁজে পেয়েছে, ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যরা এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

No comments

Powered by Blogger.