'তোমার যুদ্ধ আর আমার যুদ্ধ এক নয়!' by আবু এন এম ওয়াহিদ

১৯৯০ সালের শেষদিক। আমি তখন চার্লসটনে ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। ওই বছরের মাঝামাঝিতে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করে ইরাকের অঙ্গীভূত করেছেন। বুশ (সিনিয়র) প্রশাসন ইরাককে কুয়েত ছেড়ে আসার আলটিমেটাম দিচ্ছে, তর্জনগর্জন করছে, যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে।


আর ইরাকিরা চারদিকে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ডিফেন্সিভ পজিশন নিচ্ছে। সোশ্যাল পার্টিতে গেলে গাল্ফ ক্রাইসিস গল্প-আড্ডার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এমনি একদিন এক গল্পের আসরে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গান্ধীয়ান দর্শনে বিশ্বাসী ড. সুহৃদ দে আলোচনার একপর্যায়ে বললেন, 'নো ওয়ার ইজ হোলি', অর্থাৎ 'কোনো যুদ্ধই পুণ্যময় বা পূতপবিত্র নয়'। তিনি আরো বললেন, 'মানুষে মানুষে এমন কোনো সমস্যা থাকতে পারে না, যা আলোচনার মাধ্যমে মিটমাট করা যায় না। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, যুদ্ধ মানেই অমঙ্গল, এর কোনো ভালো দিক নেই।
তার কথা শুনে আমি বেশ অভিভূত হলাম, তাৎক্ষণিক কিছু বলতে পারলাম না, তবে মনে হলো- কথাটার মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁক আছে, অথচ আমি ধরতে পারছি না। যুদ্ধ সম্পর্কে আরো অনেক কথা আছে, যার কিছু আমি জানি কিছু জানি না। যেমন- 'তর্ক না করে যদি তর্কে জেতা যায়, যুদ্ধ না করে কেন যুদ্ধে জেতা যায় না।' 'যুদ্ধ এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা কেবল জেনারেলদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।' 'রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়, অস্ত্র দিয়ে নয়।' 'যুদ্ধের বিভীষিকা যোদ্ধার চেয়ে আর কেউ ভালো করে জানে না।' 'যুদ্ধে যারা জিতে, তাদের মতো করেই তারা ইতিহাস লেখে' ইত্যাদি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ 'কোল্ড ওয়ার' যুগের একটি মারাত্মক সামরিক সংঘাত, যার থিয়েটার ছিল ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া। এ যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর এবং ২০ বছর পর শেষ হয় ১৯৭৫-এর ৩০ এপ্রিল। মূল সংঘাতের একদিকে ছিল ভিয়েত কং গেরিলারা এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েত কংরা উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে একীভূত করে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার জন্য। অবশেষে পরাজয়ের মুকুট মাথায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। ভিয়েতনামের পক্ষে আত্মাহুতি দেয় ২০ থেকে ৩০ লাখ নিরীহ মানুষ এবং আমেরিকা হারায় ৫৮ হাজার ২২২ জন মিলিটারি ও প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য। আর খরচ হয় শত শত বিলিয়ন ডলার। এ যুদ্ধের মূল হোতা ছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং জনসনের দুর্ধর্ষ সমরমন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনামারা। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে তিনিই এ যুদ্ধকে ধাপে ধাপে এস্কেলেট করে ইন্দোচীনকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করেছেন। 'নো ওয়ার ইজ হোলি'। কথাটার গোমর ফাঁক হলো না। আমার মনের খটকা মনেই রইল। ২০০৯ সাল, ম্যাকনামারা মারা গেলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ইতিহাস হয়ে গেল। সবার চেতনায় হয়তো বা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে লাগল।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পিবিএসের (পাবলিক ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) জনপ্রিয় টক শো হোস্ট বিল মোয়ারস সেদিন তাঁর স্টুডিওতে এনেছিলেন এক ভিয়েতনাম ভেটারানকে। অনুষ্ঠানটি আমি যেহেতু শুরু থেকে শুনতে পারিনি, তাই অতিথির নামটা জানা হয়নি। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলছেন ১৯৬৮-৬৯-এর কথা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮-১৯। ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে চার্চে গিয়ে শিখেছেন, টেন কম্যান্ডমেন্টসের কথা। ওল্ড টেস্টামেন্টে লেখা আছে, 'দাও স্যাল নট কিল'। এরপর এই কচি বয়সে তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়া হলো এবং বলা হলো, ভিয়েতনাম যাও এবং আপন দেশের জন্য যত পারো শত্রু নিধন করো। তাঁর মধ্যে এক দিনের যুদ্ধের বিবরণ দিলেন এভাবে। এনকাউন্টারের একপর্যায়ে তিনি বন্দুক হাতে সাথিহারা হয়ে একেবারে একা অবস্থান নিয়েছেন ভিয়েতনামের কোনো এক জঙ্গলে। হঠাৎ দেখতে পেলেন, মাত্র কয়েক ফুট দূরে গ্রেনেড হাতে সাক্ষাৎ জম তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অল্প বয়সী ভিয়েত কং গেরিলা। তিনি আফসোস করছেন, ভিয়েতনামি ভাষা জানেন না। জানলে এখন জানটা হয়তো বাঁচাতে পারতেন। কী করবেন তিনি, পজিশন নিয়ে ইংরেজিতে বললেন, 'ডোন্ট থ্রো, আই উইল পুল দ্য ট্রিগার।' অর্থাৎ 'গ্রেনেড ছুড়ো না, আমি গুলি করব।' ওই দুঃসময়ে তিনি মনে মনে ভাবলেন, 'এটা তো যুদ্ধ, হয় তুমি আমাকে মারবে, নয় তো আমি তোমাকে মারব। জীবনের চরম ও পরম মুহূর্তে আমাদের দুজনের অবস্থা সমান সমান। হয় আমি বাঁচব নয়তো তুমি বাঁচবে।' ভাবতে ভাবতে তিনি আবার বললেন, 'ডোন্ট থ্রো, আই উইল পুল দ্য ট্রিগার।' ছেলেটি তাঁর কথা বুঝল কি না তা বোঝার কোনো উপায় নেই। এর মধ্যে সে গ্রেনেড ছুড়ে মারল, তিনি গুলি করলেন। গেরিলা টার্গেট মিস করল, তিনি টার্গেট হিট করলেন। ছেলেটি তার চোখের সামনে ছটফট করে মরে গেল। সেদিনকার এনকাউন্টার এখানেই শেষ। কয়েক বছর পরের কথা, একদিন রাতের বেলা তিনি একা গাড়ি চালাচ্ছেন ওরিগন অঙ্গরাজ্যে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নির্জন রাস্তা। দুই দিকে ঘন জঙ্গল। হঠাৎ তাঁর হেলোসিনেশন হলো। তিনি দেখতে পেলেন, তাঁর উইন্ডশিল্ডে গ্রেনেড হাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটি, সেই ভিয়েত কং গেরিলা, যাকে তিনি অনেক বছর আগে ভিয়েতনামের জঙ্গলে গুলি করে হত্যা করেছেন। চোখ বড় বড় করে গেরিলা ছেলেটি তার দিকে তাকাচ্ছে এবং বলছে, 'তোমার সঙ্গে আমার যুদ্ধ সমান সমান ছিল না। তোমার যুদ্ধ আর আমার যুদ্ধ একও ছিল না। তুমি ছিলে আমার দেশে ইনভেডার (আক্রমণকারী) আমি ছিলাম ডিফেন্ডার (আত্মরক্ষাকারী)। তোমার যুদ্ধের কোনো নৈতিক ভিত্তি ছিল না। বুঝলাম ইনভেডারের যুদ্ধ আনহোলি, অন্যায় এবং অপরাধ। ডিফেন্ডারের যুদ্ধ হোলি, ন্যায়সংগত এবং পূতপবিত্র।

লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি।
এডিটর- জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ। awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.