চারুশিল্প- দক্ষিণের ভাব ও অভিঘাত by সিলভিয়া নাজনীন

শিল্প একটি সময়ের গল্পকে অথবা তার চিন্তা-চেতনার ধরন বুনন করে চলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। স্থান-কালের আপেক্ষিকতাকে ধারণ করে অপেক্ষাকৃত তরুণ সমকালীন শিল্পীদের শিল্পকর্মের বৈচিত্র্যময় ভাবনা-আঙ্গিক শিল্পকলার নতুন অভিমুখ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অনেক সময়।


‘ইমাজিনিং আওয়ার ফিউচার টুগেদার’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে দক্ষিণ এশীয় শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনী শুরু হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। সমসাময়িক দক্ষিণ এশীয় তারুণ্যের ভাব বিনিময়ের জন্য এ প্রদর্শনীতে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ২৫ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম একসঙ্গে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে এ দেশের শিল্পপ্রেমীদের।
বৈশ্বিক বাস্তবতার জটিল অবস্থাকে প্রতিনিয়ত ভারসাম্যে রাখার একটা সুদূর পরিকল্পনা বা লক্ষ্য অন্তর্নিহিত থাকে শিল্পকলায়। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ঐতিহ্যের চর্চাকে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে ভাবনা-দৃষ্টিভঙ্গি-জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে নতুন পথের সম্ভাবনাও তৈরি হয়। সাংস্কৃতিক বলয়ে উদ্দীপনা তৈরির মাধ্যমে সব জড়তা ভেঙে সম্ভাবনার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে এই মাধ্যমে—এমন নানা ভাবনার একত্র উপস্থাপন আঞ্চলিক ঐক্য ও সমৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
নেপালের শিল্পী হিতমান গুরাং সমাজের মধ্যে নানা রকম বৈপরীত্বের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর চিত্রকর্মে রয়েছে বাস্তব জগৎ ও ধারণাগত জগতের সহাবস্থান। ‘সেইভ লাইফ টুগেদার’ ও ‘সেইভ ইওরসেলফ ফার্স্ট’—এ দুটি শিরোনামে বোঝা যায় তাঁর ভাবনার বলয়। এখানে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাস্তবতাকে একই চিত্রপটে দেখানো হয়েছে।
ভুটানের শিল্পী তেনজিং শেওয়াংয়ের ‘দি এক্সজিসট্যান্স অব ওয়ার ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের শিল্পকর্মে ভুটানের ট্র্যাডিশনাল পেইন্টিংয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অস্থির ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বর্তমানকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রের রূপে বর্ণনামূলকভাবে উপস্থাপন করেছেন।
পাকিস্তানের শিল্পী ফারাহ জানান, তিনি শৈশব থেকেই তাঁর চারপাশের পরিবেশ, উপাদান নিয়ে সচেতন ছিলেন, যা পরে তাঁর চিত্রকলায় নানাভাবে বিবৃত হয়। তিনি মূলত মিনিয়েচার পেইন্টিং দিয়ে প্রভাবিত। তবে পুরুষশাসিত সমাজে একজন নারীর সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানকে উপস্থাপন করে চলেছেন তাঁর ক্যানভাসে।
ভারতীয় শিল্পী জিজ্ঞাসা ওঝা আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতি, যা কিনা পাশ্চাত্য থেকে প্রভাবিত এবং ভারতের ঐতিহ্যগত নিজস্ব সংস্কৃতি—এই দুইয়ের আদান-প্রদান মিনিয়েচার পেইন্টিং এবং এখনকার পপুলার কালচারের অদ্ভুত সংমিশ্রণে তা ফুটিয়ে তুলেছেন। ঐতিহ্যের উপস্থাপনায় চিত্রকল্পের যে নাটকীয়তা আধুনিকতার সঙ্গে মিলে অতীত এবং বর্তমান চালচিত্র, তা শিল্পীকে তাড়িত করে।
এই প্রদর্শনীতে চিত্রকলার পাশাপাশি বেশ কিছু আলোকচিত্র গুরুত্ব পেয়েছে। আফগানিস্তানের আলোকচিত্রী ইয়ামা আজিজির ডিজিটাল আর্ট ‘দ্য ট্রি অ্যান্ড আই’ শীর্ষক ছবিটিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোয় ঐক্য-শান্তি-সৌন্দর্য-সমৃদ্ধির উন্মুক্ত পথের সন্ধান করেছেন।
শ্রীলঙ্কার আলোকচিত্রী লিজ ফার্নেন্দোর চিত্রভাষায় ভিন্নধর্মী গল্পের স্বাদ পাওয়া যায়। তাঁদের পারিবারিক সমৃদ্ধ আর্কাইভ সে দেশের বৈরী আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে না পেরে বিলুপ্তপ্রায়। তাঁর ছবি সময়কে অতিক্রম করে দর্শককে ভিন্ন পরিবেশে আচ্ছন্ন করে।
বাংলাদেশের আলোকচিত্রী মাহফুজুল হাসান ভূঁইয়া এ দেশের বিভিন্ন সহজ-সরল-সাদামাটা বিষয়কে উপস্থাপন করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। তাঁর ছবি ‘ওয়ান উমেন আর্মি’ প্রাত্যহিক কর্মময় জীবনের সরল উপস্থাপন।
বাংলাদেশের অন্য দুজন আলোকচিত্রী সরকার নোমান প্রতীকের ‘অব রিভার অ্যান্ড লস্ট ল্যান্ডস ১, ২’ নিরেট বাস্তবতাকে ভিন্ন ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করে এবং ইসমাঈল ফেরদৌসের ‘পিপল’ ছবিতে কম্পোজিশন ও বিষয়ের উপস্থাপন আলোকচিত্রকে শিল্পমাত্রায় উন্নীত করে।
এই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের চিত্রকলার উপস্থিতি নেই কেন, এ প্রশ্নে সরব ছিলেন শিল্পানুরাগীরা। আয়োজকদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর আগ্রহের ভিত্তিতেই এই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা। অন্যান্য দেশের চিত্রকলা-আলোকচিত্রের মতো বাংলাদেশেরও সব ধরনের শিল্পমাধ্যমের উপস্থাপনা থাকলে এই প্রদর্শনীকে পরিপূর্ণ বিবেচনা করা সম্ভব ছিল। বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের প্রশংসনীয় আয়োজনের পরও তাই একধরনের উদ্বেগ তৈরি হয় শিল্পপ্রেমীদের মনে।
প্রদর্শনীটি নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনেও প্রদর্শিত হবে।
অংশগ্রহণকারীরা হলেন: তেনজিন সেওয়াং (ভুটান); ফারাহ মাহমুদ আদনান, মুহাম্মদ জুনাইদ, ফাহাদ হামিদ, ফাহিম রাও, আহমেদ সাঈদ ও গাফার আফ্রিদি (পাকিস্তান); হানিফা আলিজাদা, আলি খান ইয়াজদানি, জাবিউল্লাহ শাকির আজিজ ও ইয়ামা আজিজি (আফগানিস্তান), শামিল আসলাম আহমেদ (মালদ্বীপ); লিজ ফার্নেন্দো (শ্রীলঙ্কা); পৃথিবী শ্রেষ্ঠ, কৌশল হামাল ও হিতমান গুরাং (নেপাল); কুস্তাভ নাগ, দেবাশীষ দত্ত, মাঞ্জুনাথ হোন্নাপুরা, অমিত রোমানী, নাভিন চাহাদ ও জিজ্ঞাসা ওঝা (ভারত); মাহফুজুল হাসান ভূঁইয়া, নোমান প্রতীক সরকার ও ইসমাঈল ফেরদৌস (বাংলাদেশ)।

No comments

Powered by Blogger.