বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৩৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. এজাজুল হক খান, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটির কাছাকাছি পরিখা খনন করে অবস্থান নেন।


কয়েকটি দল ও উপদলে বিভক্ত ছিলেন তাঁরা। তাঁদের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আবু তাহের (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর সঙ্গে থাকা উপদলে ছিলেন মো. এজাজুল হক খান।
মধ্যরাতে শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। বারুদের উৎকট গন্ধ, গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয় চারদিক। এ রকম যুদ্ধে রক্তপাত, একাধিক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। মো. এজাজুল হক খানসহ মুক্তিযোদ্ধারা এতে বিচলিত হননি। বিপুল বিক্রমে তাঁরা যুদ্ধ করেন। সমানতালে যুদ্ধ চলে।
সকালের দিকে যুদ্ধের তীব্রতা কমে যায়। এ সময় অগ্রভাগে থাকা মুক্তিযোদ্ধা দলের দলনেতা অধিনায়ক আবু তাহেরকে জানান, তাঁরা পাকিস্তানি দুর্গের প্রায় ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। অধিনায়ক বিজয় প্রায় হাতের মুঠোয় ভেবে মো. এজাজুল হক খানদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। একটু পর তিনি নিজেও সামনে এগিয়ে যান।
তখন আনুমানিক সকাল নয়টা। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি শেল পড়ে অধিনায়কের সামনে। বিস্ফোরিত শেলের স্প্লিন্টার লাগে তাঁর পায়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তিন-চারজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। মো. এজাজুল হক খান ছিলেন সামনে কিছুটা এগিয়ে। তিনি দ্রুত এসে অধিনায়ককে উদ্ধার করে দ্রুত নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কামালপুর বিওপিতে। জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত কামালপুর গ্রামের মাঝামাঝি বিওপির অবস্থান। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ছিল গোটা বিওপি। বিছানো ছিল অসংখ্য মাইন ও বুবিট্র্যাপ। মূল প্রতিরক্ষার চারপাশে ছিল অনেক বাংকার। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সেদিন অগ্রবর্তী দলের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য ওই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মূল প্রতিরক্ষায় ঢুকে যান। অনেক মুক্তিযোদ্ধা মাইন ও গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার পরও তাঁরা থেমে যাননি। দেশমাতৃকার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় এগিয়ে যান। অবশ্য বিজয়ী হতে পারেননি।
মো. এজাজুল হক খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে এর অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি বন্দী হন। পাকিস্তানিরা তাঁকে নির্যাতন করে, তবে হত্যা করেনি। জুলাই মাসের শেষে সেনা কর্তৃপক্ষ অঙ্গীকারনামা নিয়ে তাঁকে মুক্তি দেয় এবং চাকরিতে পুনর্বহাল করে।
কয়েক দিন পর তিনি মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার কথা বলে ছুটি নিয়ে বাড়িতে যান। তারপর পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১১ নম্বর সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টর এলাকায় কামালপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. এজাজুল হক খানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪৪।
মো. এজাজুল হক স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৮ সালে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার গোয়ালগ্রাম গ্রামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে তিনি এখানেই বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম কিফাত আলী খান, মা শাহেরা খাতুন। স্ত্রী মলিদা খানম। তাঁদের এক মেয়ে, তিন ছেলে।
সূত্র: মো. এজাজুল হক খান বীর প্রতীক, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.