ডেসটিনির শীর্ষ তিন কর্তা আত্মসমর্পণের পর কারাগারে

ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদ, ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন এবং ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।


অবৈধভাবে অর্থ হস্তান্তরের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা দুই মামলায় তাঁদের কারাগারে পাঠানো হলো। ডেসটিনি গ্রুপের এই তিন কর্মকর্তা গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জহুরুল হকের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত তা খারিজ করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে এ তিনজনকে দুটি মামলায় ১০ দিন করে মোট ২০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে গতকাল মহানগর হাকিম আদালতে এ আবেদন করা হয়। এ বিষয়ে শুনানি হবে আগামী রবিবার।
এ ছাড়া দুটি মামলায় জামিনের জন্য হারুন অর রশিদের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে হাইকোর্টে। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের বেঞ্চে আগামী রবিবার এ আবেদনের ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। তবে কারাগারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর হারুন অর রশিদ অসুস্থ প্রমাণিত হলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেলে পাঠানো হবে বলে হাইকোর্টকে আশ্বস্ত করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
ডেসটিনির এই তিন কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর সময় আদালত প্রাঙ্গণে ডেসটিনির কর্মীরা বাধা সৃষ্টি করলে পুলিশ তাঁদের ওপর লাঠিচার্জ করে।
অর্থ আত্মসাৎ, অর্থপাচার ও প্রতারণার অভিযোগে গত ৩১ জুলাই দুটি মামলা করে দুদক। অভিযোগে বলা হয়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড কর্তৃপক্ষ ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন ও ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে। কিন্তু বর্তমানে তাদের আলাদা দুটি অ্যাকাউন্টে ৫৬ লাখ এবং চার কোটি ৮৭ লাখ টাকা আছে। বাকি তিন হাজার ২৮৫ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এ দুই মামলায় জামিনের জন্য গতকাল সকাল সোয়া ৯টায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির হন হারুন অর রশিদ। আদালত বসার পর তাঁর পক্ষে জামিনের আবেদন উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু, আবু সাঈদ সাগর ও এহসানুল হক সমাজী। কিন্তু আদালতে নথি না থাকায় সিএমএম (মুখ্য মহানগর হাকিম) আদালত থেকে নথি আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে সকাল সোয়া ১০টার পর রফিকুল আমীন ও মোহাম্মদ হোসাইন একই আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। তাঁদের পক্ষেও একই আইনজীবীরা ছিলেন। সিএমএম আদালত থেকে নথি আসার পর সকাল ১১টায় জামিন আবেদনের শুনানি হয়। জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল, রফিকুল হক বেনু, কবির হোসেন। দুপুর পৌনে ১২টায় শুনানি শেষ হলেও আদালত এ বিষয়ে পরে আদেশ দেবেন বলে জানান। তবে দুপুর সাড়ে ১২টায় জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর কারাগারে এ আসামিদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেওয়ার আবেদন করা হয়। তবে আদালত কারাবিধি অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
জামিন আবেদনের শুনানিতে আসামিপক্ষ থেকে বলা হয়, এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। সিএমএম আদালত থেকে গত ৬ আগস্ট তাঁরা জামিন পান, যা দুদকের রিভিশনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাতিল হয়ে যায়। সিএমএম আদালত জামিন মঞ্জুরের পর তাঁরা জামিনের কোনো শর্ত ভঙ্গ করেননি। আদালতের নির্দেশমতো আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন তাঁরা। আসামিরা বয়স্ক ব্যক্তি। তাঁদের সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় জামিন মঞ্জুর করার আবেদন করা হয়।
জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। এটা সাধারণ জনগণের টাকা। রাষ্ট্র ও জনগণ আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে। জামিন-অযোগ্য ধারার মামলা। গত ২৭ সেপ্টেম্বর এ আদালত আসামিদের জামিন বাতিল করে অবিলম্বে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। তাঁরা আদালতের নির্দেশের ১২ দিন পর এসেছেন। আদালতের আদেশ যথাযথভাবে পলন করেননি। তাই তাঁরা জামিন পেতে পারেন না।
হাইকোর্টে জামিনের আবেদন : এদিকে নিম্ন আদালতে জামিনের আবেদন খারিজ হওয়ার পরপরই গতকাল দুপুরে লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদের জন্য বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে জামিনের আবেদন করা হয়। আদালত তাৎক্ষণিকভাবে এ আবেদনের ওপর শুনানিতে রাজি হননি। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনতে চান আদালত। বিকেলে অ্যাটর্নি জেনারেল হাজির হওয়ার পর শুনানি করেন হারুন অর রশিদের আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু। তিনি বলেন, 'তাঁকে (হারুন অর রশিদ) জামিন দেওয়া বা না দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের আছে। তবে তাঁকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে পাঠানোর আবেদন করছি। কারণ হারুন অর রশিদ সাবেক সেনাপ্রধান। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার। তিনি গুরুতর অসুস্থ। হার্টের সমস্যায় ভুগছেন।' আদালত তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর আদেশ দিতে গেলে বিরোধিতা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, 'তিনি তো এখনো কারাগারে যাননি। কারাগারে গেলে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইজি প্রিজনকে বলব।' তিনি বলেন, হারুন অর রশিদের অসুস্থতার সমর্থনে কোনো কাগজপত্র নেই। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন আবেদনের শুনানিতে অসুস্থতা সম্পর্কে কোনো কিছু বলেননি। এ মুহূর্তে তাঁকে জামিন দেওয়ার সুযোগ নেই।
ওই সময় আদালত বলেন, 'তিনি একজন সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ও সেক্টর কমান্ডার। তিনি সম্মানিত ব্যক্তি। এর আগেও তো হাসপাতালে পাঠানোর ঘটনা আছে। তা ছাড়া আব্দুল মতিন খসরুর কথা কি বিশ্বাসযোগ্য নয়? তা ছাড়া তাঁর কিছু হলে আপনি বা আমরা দায়ী হব।' আদালত আরো বলেন, 'অর্থ কেলেংকারির ঘটনা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ডেসটিনির প্রতি আমাদের নূ্যনতম সহানুভূতি নেই। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।'
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, নিয়ম অনুযায়ী যা করার সব হবে। কারা কর্তৃপক্ষই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, 'হারুন অর রশিদ ডেসটিনি থেকে মাসে ১০ লাখ টাকা বেতন নেন। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি ডেসটিনি ছাড়তে পারবেন না। তাই বলে কি উনি চোরদের সঙ্গে থাকবেন?' ওই সময় আদালত বলেন, 'আমি হলে পদত্যাগ করতাম।'
পুলিশের সঙ্গে ডেসটিনিকর্মীদের সংঘর্ষ, আহত ৭০ : পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আদালত ডেসটিনি গ্রুপের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়ার পর কড়া পুলিশ পাহারায় তাদের প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। ওই সময় হঠাৎ করেই শতাধিক লোক পুলিশের ভ্যানটি ঘিরে হারুন অর রশিদ ও রফিকুল আমীনের মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিতে শুরু করে। ডেসটিনির কিছু কর্মী প্রিজন ভ্যানের সামনে শুয়ে পড়েন। পুলিশ বাধা দিলে তাদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। একপর্যায়ে পুলিশ লাটিচার্জ করে ডেসটিনিকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু কর্মীরা আশপাশের গলিতে অবস্থান নিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশের ওপর। এ অবস্থায় পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে রাস্তা থেকে লোকজন সরিয়ে দেয়। পুলিশের লাঠিচার্জে কমপক্ষে ৭০ জন আহত হয়। ওই সময় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষ চলে।
জানা যায়, সংঘর্ষের সময় ডেসটিনির ওপর ক্ষুব্ধ কিছু লোক রফিকুল আমীনকে উদ্দেশ করে 'চোর, চোর' বলে চিৎকার করে তাঁর দিকে ইটের টুকরা ছুড়ে মারে। প্রিজন ভ্যানের গায়ে লাগে সেগুলো। পুলিশ দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করে। ঘটনার একপর্যায়ে আদালতসংলগ্ন জনসন রোডে এটিএন নিউজের একটি গাড়িতে হামলা চালায় ডেসটিনিকর্মীরা।
এ ব্যাপারে ডিএমপির লালবাগ জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার হারুনুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ডেসটিনির শীর্ষ তিন কর্মকর্তাকে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানোর সময় বিক্ষুব্ধ কর্মীরা বাধা দেয়। তারা পুলিশ ও প্রিজনভ্যান লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোড়ে। লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি শান্ত করে পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.