হৃদয়নন্দন বনে-দুনিয়াটা অত সহজে ধ্বংস হবার নয় by আলী যাকের

আমার গেল সপ্তাহে কলামটির নামকরণ করা যায় বিষণ্ন কলাম! চারদিকে এত বেদনাদায়ক ঘটনার সমাগম যে, থিতু হয়ে বসে হৃদয়নন্দন বনে উচ্চারিত আনন্দঘন কথা বলার সুযোগ কোথায় আমাদের এই বাংলাদেশে? একটু বোধহয় ভুল বললাম। বলা উচিত ছিল সুযোগ কোথায় আজকের এই অস্থির বিশ্বে?


সম্প্রতি আমার এক ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে টেলিফোন এসেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার নিবাস। আমাকে সে জিজ্ঞেস করল, 'আসবে নাকি এই শরতে আমাদের দেশে?' ও জানে, যে কোনো শীতের দেশের শরৎকাল বড় হৃদয়গ্রাহী হয়, বর্ণময় হয়। আমি অতীতে অনেকবার এই শরৎ দেখার জন্যই কেবল কোনো না কোনো অজুহাতে শীতপ্রধান দেশে ভ্রমণ করেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতলান্টিক সাগর ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে যে পথ তার উভয় পাশে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি হয় শরতে। মার্কিনিরা শরৎকালকে ঋধষষ বলে। এর কারণ বোধহয় এই যে, ওই সময়েই সমস্ত বৃক্ষরাজির এমনকি ছোটখাটো গাছগাছালিরও পাতা পড়তে শুরু করে এবং ওই পাতা পড়ার মধ্যেই নিহিত থাকে ধূসর শীতকালের আগমন বার্তা। তখন সকল মানুষ তীব্র ঠাণ্ডায় বেঁচে থাকার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গাছপালা সব পত্রপুষ্পহীন হয়ে যাবে, তুষারপাত শুরু হবে, রাস্তাঘাটে চলাফেরা ভারি কঠিন হয়ে পড়বে। আমি আমার বন্ধুটিকে বললাম, 'না, এবারে আর যাচ্ছি না।' বন্ধুটি জিজ্ঞেস করল, 'কেন?' আমি তাকে বললাম, 'মনটি ভারি বিষণ্ন।' ও ধরেই নিয়েছিল যে, আমাদের মতো বাংলাদেশিদের মন বিষণ্ন হতে পারে, কেবল দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্যই। তাই জিজ্ঞেস করল, 'কেন? মন খারাপ করা কিছু কি ঘটেছে নাকি দেশে সম্প্রতি?' জবাবে আমি বললাম, 'ঘটছে তো প্রত্যহই। তবে এ আর এমন কি। সারাবিশ্বে যে বহমান অস্থিরতা, তারই তরঙ্গ ওঠে আমাদের জলাভূমিতেও। এ-ই তো বিষয়।' সে বলল, 'হেঁয়ালি রেখে আসল কথা বল কী হয়েছে?' জবাবে আমি বললাম, 'দায়ী তো তোমরাই!'
অতঃপর এর ব্যাখ্যা দিতে হলো। কেননা, আমার বন্ধুটি মনে করল যে আমার এই সরাসরি জবাব আরও বেশি হেঁয়ালিগ্রস্ত। আমি তাকে বলেছিলাম, বিশ্বের যেখানে যা-ই ঘটুক না কেন, তার পেছনে মার্কিন সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ উস্কানি একেবারে পরিষ্কারভাবে কাজ করে। আজ থেকে বহু বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে অকস্মাৎ জীবন বিধ্বংসী অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ থেকে শুরু করে কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট নিধনের অজুহাতে যে হত্যাযজ্ঞ এবং অতঃপর কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আগ্রাসন, ওদের ল্যাজের কাছে অবস্থিত লাতিন আমেরিকায় মার্কিনিদের যে গণবিরোধী ভূমিকা_ এসব তো আজ ঐতিহাসিক সত্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত এবং বিভিন্ন সময় মার্কিন সরকারের সৃষ্ট এসব বিরোধে তাদেরই পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। তা জেনেও তারা একের পর এক ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নতুনতর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পর্যন্ত যে অস্থির অবস্থা এবং হানাহানি আজ প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, এর সবই এককভাবে শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বোধকরি এর প্রধান কারণ হলো, রাজনীতিতে আজকে ভারসাম্য রক্ষা করার মতো কোনো দ্বিতীয় পরাশক্তি আর নেই। অতএব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বলে কিংবা করে, সেটাকেই বৈধ বলে ধরে নিতে হয়। দুর্মুখেরা বলেন, এর পেছনে ওই পরাশক্তির নিজস্ব লাভ-লোকসানের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ইরাকে যুদ্ধ, লিবিয়ায় গাদ্দাফির শাসনের অবসান, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, কিংবা ইরানকে হুমকি-ধমকি এসবেরই পেছনে নাকি রয়েছে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য বিস্তারের অভীপ্সা। যাতে করে ভবিষ্যতে তেল নামক অতিপ্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ দাহ্য পদার্থটির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কারও কাছে হাত পাততে না হয়। মুক্তচিন্তার অর্থনীতিবিদরা, যারা নব্য ধ্রুপদী অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে মোটামুটি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক এবং স্বনির্ভর অর্থনীতির ধারক এবং বাহক, তারা এই কথা বলেন এবং বলাই বাহুল্য যে, এসব অর্থনীতিবিদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তল্পিবাহক নন। হতে পারে এটিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত পরিকল্পনা। তবে আপাতদৃষ্টিতেও যা দেখা যায়, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারি যে, তাদের সকল কৌশলই আসলে ভ্রান্ত অনুমানের ওপর নির্ভরশীল। অতএব, এখন যখন তারা ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন আমাদের না হেসে উপায় থাকে না। মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশকে একের পর এক মার্কিনিরা ধ্বংস করেছে, একবার সেগুলোর দিকে তাকাই।
ইরাকের সাদ্দাম হোসেন অবশ্যই স্বৈরাচারী, একনায়ক ছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি। তাকে হত্যা করে ইরাকের ধর্মীয় মৌলবাদকেই উস্কে দিয়েছে মার্কিনরা। লিবিয়ার সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়। আর যা-ই হোক না কেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি কখনোই ধর্মান্ধ ছিলেন না। তবে স্বৈরাচারী একনায়ক ছিলেন, এ কথা অনস্বীকার্য। সেখানেও কিন্তু তার বিনাশের পরে আমরা উগ্র ধর্মান্ধতার উত্থান দেখতে পাই। সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি আসাদ অবশ্যই একজন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, যিনি তার হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করেন। তাকে সরিয়ে দিয়েও ওই একই ঘটনা সেখানে ঘটবে। আফগানিস্তানে তালেবান সৃষ্টির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই মূল ভূমিকা পালন করে এবং এই পরিকল্পনা কার্যকর করে তারা পাকিস্তানের আইএসআইর সাহায্য নিয়ে। প্রথম ছিল যারা মুজাহিদিন, তাদের সরিয়ে দিয়ে এলো তালেবান। বস্তুতপক্ষে ওসামা বিন লাদেনও পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। যদি এটাই সত্য হবে যে, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মার্কিন প্রশাসন বিশ্বময় একনায়কত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, তাহলে তো সঙ্গত কারণেই তাদের সহায়তা করতে হতো এসব দেশে সেসব রাজনৈতিক নেতাকে, যারা গণতান্ত্রিকভাবে স্বৈরাচারীকে হটাতে পারে। সৌদি আরব এবং কুয়েত_ এই দুটি দেশ কখনোই গণতান্ত্রিক ছিল না। তাদের শাসন কর্তারা অবশ্যই একনায়কত্বে বিশ্বাস করে এবং নিজের প্রজাদের কঠোরভাবে দমন-পীড়ন করে। তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের কখনোই কোনো অভিযোগ নেই। তাহলে কি একথা সত্য বলে মেনে নিতে হবে যে, ওই সব গণমানুষবিচ্ছিন্ন সম্রাট ও শাসকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তোষণ করে চলে এবং নিয়মিতভাবে ভেট দিয়ে থাকে? মার্কিনিদের ন্যক্কারজনক আরও একটি দিক সম্বন্ধে এখানে না বললেই নয়। পাকিস্তানকে তারা সবসময় ব্যবহার করে এসেছে তাদের গোপন দুরভিসন্ধিগুলোকে সফল করার জন্য। এই কারণেই আজ পাকিস্তান নিজেদেরই একাংশ জনগোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ত হানাহানির আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। অথচ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সকল সমর্থন গুটিয়ে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ কাজের সময় কাজি...!
এই যে নিজ স্বার্থের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবিবেচনাপ্রসূত ভূমিকা, এর দ্বারা আপাত শান্ত এবং গণতন্ত্রমনা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগুলোতেও আস্তে আস্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। ভারত কিংবা বাংলাদেশ অথবা মিয়ানমার কিংবা শ্রীলংকাও এই দুর্গতির বাইরে নয়। আজকের বিশ্বে একমাত্র পরাশক্তি তার নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে একের পর এক, তার ফলে আমাদের সকলের জীবনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। আমরা চাই না পত্র-পুষ্প-পল্লবিত আমাদের এই দেশগুলো শরৎ শেষে ধূসর, বরফাচ্ছন্ন জনপদে পরিণত হোক। আমরা সকলেই জানি যে, বিশ্বায়নকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে সকল পরাশক্তি আমাদের ওপর সর্বদাই ছড়ি ঘোরাচ্ছে। সেই বিশ্বায়নেরই সুযোগ গ্রহণ করে আমাদের বিশ্বের সকল মানুষের সঙ্গে একটি সংযোগ স্থাপন করতে হবে, ঠিক যেমন '৭১-এ আমরা করেছিলাম। সে সময়ের মার্কিন সরকার যতই বাংলাদেশবিরোধী হোক না কেন, মার্কিন জনগণ বাংলাদেশিদের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকে যে আহ্বান এসেছিল, সেটাই কবিতার খাতায় রূপান্তরিত হয়েছিল তখনকার আমেরিকার প্রধান কবি অ্যালেন গিনস্্বার্গের সেপ্টেম্বর ইন যশোর রোড কবিতায় এবং কবিতার পাতা থেকে সকল স্বাধীনচেতা, গণতন্ত্রমনা মার্কিন জনগণের হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আহ্বান। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সর্বতোভাবে আমেরিকার অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেনের জনগণের সচেতনতা বাংলাদেশের পক্ষে এক দুর্মর সমর্থন গড়ে তোলে।
আসলে যে কোনো সমাজে সুস্থ চিন্তার মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অতএব, যে কোনো দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রে বিশ্বময় সকল জনগণের মাঝে আমাদের গড়ে তুলতে হবে এক সংবেদনশীল সম্পর্ক। তবে সবচেয়ে বড় কথা যে কোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছে আজকের মানুষ, এমনকি পাকিস্তানের স্বাধীনচেতা কিশোরী মালালা ইউসুফজাইও। তাকে নিষ্ঠুর তালেবানরা গুলিবিদ্ধ করলেও বিদ্যার্জনে তার যে অবস্থান, তাতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এভাবে ভালো মানুষ ক্রমেই উচ্ছেদ করবে কিছু খারাপ মানুষকে। আমরা অত সহজে হেরে যাব না। দুনিয়াটা অত সহজে ধ্বংস হবার নয়।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.