এক মুঠো সমুদ্রের গর্জন by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

আমদের এই পৃথিবী একটা সময় নাকি সম্পূর্ণ জলে পরিপূর্ণ ছিল। সেই জলে প্রথম প্রাণের সঞ্চার। সেই জলে প্রথম মাটির আবির্ভাব। আদিম জলজ প্রাণী সেই মাটিতে তার চরাচর সৃষ্টি করেছে। সেই চরাচরে কালক্রমে মানুষের আবির্ভাব।


মানুষের পদচারণা বেড়েছে প্রতিনিয়ত। প্রথমে ছোট্ট একটি ভূখণ্ড, তারপর একটি দেশ, এরপর মহাদেশ। এভাবেই মানুষ বেড়েছে। মানুষ বাড়লেও শুরুর সেই সমুদ্র কিন্তু রয়ে গেছে আগের মতো। বিক্ষুব্ধ অথচ শান্ত।
সমুদ্র তার বিশালতা নিয়ে এক অপার বিস্ময় রূপে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। দিগন্ত বিস্তৃত সীমানা, নীল জলের হাতছানি আর সুবিশাল ঢেউয়ের উন্মাদনা সমুদ্রকে আলাদা মাত্রা দেয়। এই সমুদ্র মানুষকে কাছে ডাকে। আমার মনে হয়, মনের ভার বেড়ে গেলে সমুদ্রে যাওয়া দরকার। আমার এই মতের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করবেন। সেই সঙ্গে মনে হয় সমুদ্র তার বিশাল অন্তর খালি করে রেখেছে। সমুদ্রে অবগাহনে সেই ভারমুক্তি ঘটবে।
সমুদ্রে অবগাহনের কথা মনে হলে আমার প্রথমে কক্সবাজারের কথা মনে পড়ে। বিশ্বের আরও কয়েকটি সমুদ্রে যাওয়ার সুযোগ এসেছে আমার। কিন্তু সমুদ্রের কথা মনে হলে আমার কক্সবাজারের কথাই মনে পড়ে। সেখানে আমি যতবার গিয়েছি ততবার সমুদ্রে অবগাহন করেছি জোয়ার-ভাটার হিসেব না করেই। একবার প্রায় বিপদেই পড়েছিলাম, যখন দেখলাম সমুদ্র আমাকে প্রায় তার ভেতর টেনে নিয়ে যাচ্ছে; মনে হচ্ছিল আমি আর ফিরতে পারব না। আরও ভয় পেয়ে গেলাম যখন দেখলাম পায়ের নিচের বালু শিরশির করে চলে যাচ্ছে। ঢেউ নেমে যাওয়ার পর আবার সব ঠিক হয়ে গেল আশ্চর্যভাবে। ভয়ের এমন আরও কিছু স্মৃতি থাকা সত্ত্বেও আমি সমুদ্রে গিয়েছি। নোনাজলে অবগাহন করেছি।
সমুদ্রের এত এত বিশেষত্বের মধ্যে আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। এ গর্জনকে সমুদ্রের আহ্বান বলা ভালো। এ গর্জনও আমাদের সব সময় ডাকে। সেই ডাককে ভয় পেয়ে এবং সেই ডাককে ভালোবেসে আমি 'একমুঠো সমুদ্রের গর্জন' কবিতাটি লিখি। আমার একটি কবিতার বই ওই শিরোনামে প্রকাশিত হয় ২০০৮-এর অমর একুশে বইমেলায়। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এ বইয়ের এক অপরূপ প্রচ্ছদ করেছেন। কবিতাটি নিচে তুলে দিলাম_

সমুদ্রের গর্জনে আমি বড় ভয় পাই।
আবার
সমুদ্রের গর্জন আমি বড় ভালোবাসি।
সমুদ্র যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আরও এগিয়ে আসছে এক সন্ন্যাসী
কমণ্ডলু হাতে।
আমি অসম্ভব ভয় পেলাম।
সেই ছোটবেলাকার ভয়
ছেলেধরা সন্ন্যাসীদের ভয়!
যারা কালীর নামে
শিশুকিশোরদের বলি দিত,
যারা সেতু নির্মাণে
শিশুকিশোরদের বলি দিত,
সেই সন্ন্যাসীদের ভয়!

আমার নিঃশ্বাস বন্ধ
আমি স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কোন ভ্রূক্ষেপ না করে
সন্ন্যাসী আমার পাশ কাটিয়ে
দিগন্তের দিকে গেল চলে।

সমুদ্রের গর্জন তীব্রতর হয়।
আমার কিন্তু আর ভয় করে না
আলগোছে বালু থেকে তুলে নিলাম
একটা ঝিনুক।
আমার মুঠোর মধ্যে
ন্যানোটেকনলজির সে এক অপরূপ নিদর্শন।
বড় আনুগত্যে ঝিনুক বয়ে চলে সেই সমুদ্রের গর্জন
আমার মুঠোর মধ্যেই সেই সমুদ্রের গর্জন
ঝিনুকে কান পাতলে তা শোনা যায়।

এই কবিতাটি আমি ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি নিয়ে লিখেছি। আমরা তখন মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুরে বাস করতাম। ভগীরথী নদী সেই শহরের মাঝখান দিয়ে যায়। একপাড়ে রঘুনাথগঞ্জ, অপর পাড়ে জঙ্গীপুর। আমি বলতাম বুডা ও পেস্ট-এর মাঝে যেমন দানিউব নদী বইত তেমনি ভগীরথী বইত রঘুনাথগঞ্জ ও জঙ্গীপুরের মাঝ দিয়ে। সেই নদীতে বৈশাখ মাসে অনেক সময় হাঁটুজল থাকত। সে নদীর বালু ছিল শুভ্র। এক সন্ধ্যায় সেই বালুকাবেলায় এক সন্ন্যাসীকে আসতে দেখে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। সেই সন্ন্যাসীর কথাই আমার ওপরের কবিতায় এসেছে। সমুদ্রের ঢেউ দেখে সেই সন্ন্যাসীর স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল আমার।
সমুদ্র কেন কাছে ডাকে মানুষকে? এ প্রশ্নের উত্তর অনেকে অনেকভাবে দিতে পারে। আমার কাছে মনে হয় সমুদ্রের বিশালতার কাছে গিয়ে নিজেকে নগণ্য মনে হয়। নিজের ক্ষুদ্রত্ব চোখে পড়ে। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়_ সমুদ্রের উন্মুক্ততা এবং স্বাধীনতা দেখলে স্বাধীন হতে ইচ্ছে করে। এক অনাবিল মুক্তির আনন্দ পাওয়া যায়। যতবারই মানুষ সমুদ্রের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমুদ্রের কাছে যায়, সমুদ্র নিরাশ করে না কাউকে। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে মানুষকে মুক্তির আনন্দ লাভে সাহায্য করে। সমুদ্রের ঢেউ, ঢেউয়ের গর্জন, অশান্ত বাতাসের পারাপার, সম্মুখে সীমাহীন বিশালতা আর বাধাহীন বালুর অঞ্চল। এতসব কিছু একসঙ্গে আর কোথায় মেলে?
কক্সবাজার ছাড়াও আমি সমুদ্র স্নান করেছি দুই মহাসাগরে। একটি হলো প্রশান্ত মহাসাগরের ওয়ে ওয়াক সমুদ্র তীরে। ১৯৯৭ সালে আমি পাপুয়া নিউগিনি গিয়েছিলাম সেখানকার সাধারণ নির্বাচন পরিদর্শনের জন্য। সেখানে আমার কটেজের কাছেই ছিল সমুদ্র। বেশ কবারই আমি সেখানকার সমুদ্রে গিয়েছি কটেজের কাছে বলেই। এখানকার সমুদ্রের বিশেষত্ব হলো এখানকার সমুদ্র ধীরে ধীরে নিচু হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে আমি সেখানে নির্ভয়ে সমুদ্র স্নান করতে পেরেছি। চোরাবালির কিংবা ডুবে যাওয়ার ভয় হয়নি। বাইরের সমুদ্রের কথা মনে এলে হাঙ্গরের কথা মনে আসে। কিন্তু সেখানে কেউ হাঙ্গরের ভয় দেখায়নি। কিংবা আমিও হাঙ্গরের দেখা পাইনি। পাপুয়া নিউগিনিতে কুমির সংস্কৃতি খুব প্রবল। তবে সমুদ্রে কুমিরের কথা কেউ বলেনি। পাপুয়া নিউগিনির পিজিন ভাষায় জল, জলস্রোত বা নদীর জন্য একটাই শব্দ_ ওয়ারা। সেখানে মজার বিষয় হলো সমুদ্র হচ্ছে_ সলওয়ারা, নোনাজল। হ্রদ হচ্ছে_ রাউনওয়ারা, গোলাকার জল।
আটলান্টিক মহাসাগরেও আমি সমুদ্র স্নান করেছি। অ্যান্টিগা ও বারবুডায় সাধারণ নির্বাচন পরিদর্শনে জন্য আমি অ্যন্টিগায় গিয়েছিলাম। সেখানে হোটেলের পাশেই ছিল সমুদ্র। সেই সমুদ্রের রঙ ছিল অপরূপ নীল। সমুদ্রের জল এত নীল আমি এর আগে কোথাও দেখিনি। আটলান্টিক মহাসাগরে হাঙ্গরের ভয় ছিল। তাই সমুদ্র স্নানে আগতদের নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু জায়গা জাল দিয়ে ঘেরা ছিল। ভয়হীনভাবে আমি সেখানে সমুদ্র স্নান করেছিলাম।
সমুদ্রের শান্ত রূপ যতটা মানুষকে মুগ্ধ করে উল্টোভাবে সমুদ্রের রুদ্র রূপও আছে। সেটা অনেক ভয়ঙ্কর। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কথা আমরা বছরে কয়েকবার শুনি। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ হলে ভয়ের কিছু নেই। কারণ আবার সেখানে শান্ত রূপ বিরাজ করবে ঝড় থেমে গেলেই। আর ঝড়-বৃষ্টি বা ধ্বংসযজ্ঞের শেষে আমাদের জীবনে যে প্রশান্তি নামে সে কথা আমি লিখেছি 'বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ' নামে একটি কবিতায়। কবিতাটি এরকম :

সাগরে
বাংলার সাগরে
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ,
হৃদয়ে
আমার হৃদয়-সাগরে নিম্নচাপ!
সেবার আকাশ ছিল একশ' ফারেনহাইটে জব্দ
মাথার ওপরে অস্বাভাবিক আকাশ ছিল স্তব্ধ।
এবার বেজার-মুখ মুখবিষ বাতাসের নিঃশ্বাস বন্ধ_
একশ' মাইল বেগে ঝড় আসবে, নেই তাতে সন্দ!

নীল সৌদামিনী ছিনিছিনি খেলে আকাশের গায়ে
বিজুরিদের জারিজুরি, আকাল ছিন্নভিন্ন তাদের হামলায়।
প্রকম্পিত বসুন্ধরায়, বজ্র প্রবেশ করে।
উষ্ণ বীর্য উপ্ত হয়, বৃষ্টিধারা ধরে।
বিদীর্ণ বসুন্ধরা তারে নেয় আপন করে।

ঝড়বৃষ্টির শেষে প্রশান্তি নামবে
কৃষকরা লাঙল নিয়ে মাঠে নামবে
নদীতে নৌকারা পাল তুলবে
আবার আর এক যাত্রা শুরু হবে।
ঝড়-বৃষ্টির পরেই নিমপাতা হাসবে।

ঝড়-বৃষ্টির পরেই ঝিরঝির বটপাতা হাসবে।
তুমি দেখবে ঝকঝকে নিমগাছ হাসছে।
মনে হবে দূরে ওই স্বর্গও হাসছে।

সমুদ্র নিয়ে অনেক কথাই বলা সম্ভব। কিন্তু একটি বিষয় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে_ সমুদ্র আহ্বান করে। সমুদ্র চায় মানুষ তার কাছে যাক। সমুদ্রের ডাক অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। প্রতিটি মানুষ জীবনে একবার হলেও সমুদ্রে যেতে চায়। আর সমুদ্রে গেলে গতানুগতিক জীবনের বাইরে এক অন্য জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়। হ
 

No comments

Powered by Blogger.