দুর্যোগ প্রশমন দিবস-দুর্যোগ প্রশমনে নারী by মাহবুবা নাসরীন

১২ অক্টোবর ২০১২ তারিখ বিশ্বব্যাপী পালিত হবে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস আর বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হবে ১৩ অক্টোবর ২০১২। বাংলাদেশের মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির নিয়ত লড়াই করতে হয় নানা দুর্যোগের সঙ্গে। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচন এই দুটি বিষয়ের সঙ্গেই কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতি জড়িত যা বিভিন্ন


দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরা ও অন্যান্য দুর্যোগ দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় নারী ও পুরুষের দুর্যোগ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এবারের আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসের প্রতিপাদ্য 'উইমেন অ্যান্ড গার্লস-দ্য ইনভিজিবল ফোর্স অব রিজিলিয়েন্স'। এই আলোকে বাংলাদেশে দিবসটির স্লোগান হচ্ছে_ 'দুর্যোগ সহনশীল দেশ গড়ি, সহায়ক শক্তি বালিকা ও নারী'।
সমাজে শিশুদের সামাজিকীকরণ হয় ছেলে বা মেয়ে হিসেবে, যা পরে তাদের নারী বা পুরুষ হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে। গ্রামের নারী গৃহভ্যন্তরে থেকেও দুর্যোগ মোকাবেলায় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে। বন্যা, খরা ও মঙ্গার মতো দুর্যোগে খাদ্য সংগ্রহ এবং বিতরণ, সন্তান লালনপালন, পানীয়জল আহরণ, গবাদিপশুপাখির দেখাশোনা এবং পরিচিত পরিবেশ থেকে বিকল্প খাদ্য অনুসন্ধান করে বৈরী পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের সংগ্রামে সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে। এভাবেই বাংলাদেশের নারীরা দুর্যোগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকির মধ্যে থেকেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতিতে সহজাত সঞ্চয় প্রবণতা, দুর্যোগকালীন নারীর কর্মদক্ষতা এবং দুর্যোগ উপশমে নারীর সহমর্মিতা একটি জনগোষ্ঠীকে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে।
প্রবন্ধকারের দীর্ঘকালীন গবেষণালব্ধ (নাসরীন, ১৯৯৫, ২০০৮, ২০১০) তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় যে, দুর্যোগের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য গ্রামীণ নারীরা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ফসল উত্তোলন-পরবর্তী বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কার্যক্রম, গরু মোটাতাজাকরণ, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, শাকসবজি চাষ, হস্তশিল্প ইত্যাদি আয়মূলক কাজ করে থাকে। নারীদের এসব কর্মকাণ্ডে মেয়েশিশুরা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়াও নিজ সম্পদ বিক্রি, খাদ্য গ্রহণের ধরন পরিবর্তন, প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর নির্ভরশীলতা, সামাজিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীলতা, পানীয়জল সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে নারীরা দুর্যোগের সময় পরিবারের সদস্যদের সব ধরনের সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু তাদের এ অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না বরং তাদের নাজুকতা ও অসহায়ত্বকেই বেশি তুলে ধরা হয়। এর কারণ যে কোনো দুর্যোগে বাসস্থান, খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় নারীকেই, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। কাজের সন্ধানে পুরুষ যখন বাইরে চলে যায়, তখন গৃহভিত্তিক কাজ ও সন্তানের দায়িত্ব নারীকেই কাঁধে তুলে নিতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মা প্রথমে শিশুর বইগুলো রক্ষার চেষ্টা করেন। নিজের নাজুকতাকে উপেক্ষা করে শিশুর খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য নারী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এমনও দেখা গেছে, নিজে পানিতে দাঁড়িয়ে শিশুটিকে মাচার ওপর রেখে কোমরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন। এ ছাড়াও ইতিমধ্যে লোনাপানিতে ধান ও মাছ চাষ, ডাইক, কচুরিপানা, কখনও খাঁচার মধ্যে হাঁস-মুরগি পালন, বিভিন্ন আয়মূলক কাজ করে নারীরা অভিযোজন করছে। আর এভাবে গড়ে তুলছে এ দুর্যোগ সহনশীল দেশ। এভাবে তাদের নিজস্ব লোকায়ত জ্ঞান ও নারীর নেওয়া অভিযোজন কৌশলগুলোই দুর্যোগে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। 'ধান-পাটের চক তলাইয়া গেলে পুরুষের আর কী কাজ থাকে?' নারীর এই যুক্তি তাকে খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবা দিতে উদ্বুদ্ধ করে। এর ভিত্তিতে গবেষক দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন তত্ত্ব তৈরি করেন_ 'নারীর নিজস্ব কৌশল আর অকাঠামোগত ব্যবস্থাই দুর্যোগের সঙ্গে অভিযোজনের অন্যতম কৌশল।'
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীর অন্তর্ভুক্তি : বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর কীভাবে দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করছে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। যদিও দুর্যোগ সব মানুষের জন্যই সমস্যা, কিন্তু সবচেয়ে সংকটে পড়েন গ্রামীণ নারী ও শিশুরা, যারা সমাজের দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতম। কারণ, খানা-পরিবারের সঙ্গে নারীদের আছে নিবিড় বন্ধন, আছে পুরুষের তুলনায় ব্যাপকতর ভূমিকা এবং সর্বোপরি সমাজে তাদের জেন্ডার পরিচয়। প্রতিকূল পরিবেশে নারীরা তাদের দায়িত্ব পালনের পরও পরিবারের সদস্যদের দুর্যোগজনিত সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। নারীদের নেওয়া এসব অভিযোজন কৌশল অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দৃষ্টির আড়ালে থাকে এবং স্বীকৃতি পায় না। অথচ বাস্তবে দুর্যোগের সঙ্গে টিকে থাকার এসব কৌশল অবলম্বনে নারীদের ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশের নারীদের বলা হয় দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দারিদ্র্যের বিভিন্ন মাত্রা নির্ধারণের ভিত্তিতে নারী-পুরুষ সমতা, শিক্ষা ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে বৈষম্যের অনুপাত ইতিমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা ০৮-এর বিপরীতে ০৯-এ নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত পরিকল্পনায় জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বাজেটে পূর্ববতী বাজেটের তুলনায় জেন্ডার সংবেদনশীল করার জন্য জেন্ডার বাজেটিং ৪টি মন্ত্রণালয় থেকে বাড়িয়ে ১০টি মন্ত্রণালয়ে করা হয়েছে। এগুলো হলো_ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, পরিবেশ ও বন, মৎস্য ও পশুসম্পদ, ভূমি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়গুলো বেশ কয়েকটি নারী স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ (আইডিএমভিএস) 'নারী ও বালিকা দুর্যোগ প্রতিরোধের নীরব শক্তি' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। এ গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রত্যয় উপস্থাপনা ও পরিচালনায় ছিলেন প্রবন্ধকার। গোলটেবিল বৈঠকের প্রতিপাদ্য ছিল দুর্যোগে নারীর ও বালিকাদের শুধু নাজুক হিসেবে উপস্থাপন করার কারণে দুর্যোগ প্রতিরোধে তাদের অবদান অস্বীকৃতই থেকে যায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক অভিযোজন প্রক্রিয়া ও ঝুঁকি হ্রাসে জেন্ডারভিত্তিক অর্জনও আশাব্যঞ্জক নয়। যার প্রতিফলন দেখা গেছে জাতিসংঘের আইএসডিআর কর্তৃক হিউগো ফ্রেমওয়ার্ক ফর অ্যাকশনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় এশিয়া অঞ্চলভিত্তিক সমন্বিত প্রতিবেদনে (২০১১)। এ বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে অনুষ্ঠিতব্য ২০১২ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস দিবসের নির্ধারিত প্রতিপাদ্যের আলোকেই এই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে প্রতিমাসে দুর্যোগে নারী ও বালিকাদের অবদান নিয়ে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকে। ২০১২ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো কর্তৃক হিউগো ফ্রেমওয়ার্ক ফর অ্যাকশনের মনিটরিং প্রতিবেদনে দুর্যোগে নারী ও বালিকাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে উপাত্ত দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস সামনে রেখে ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের (আইডিএমভিএস) আনুষ্ঠানিক যাত্রার সূচনা হয়। সবশেষে বলা যায়, যেহেতু নারীরা দুর্যোগের সময় তাদের পরিবার রক্ষা বিশেষত শিশু ও কিশোরী, বয়োবৃদ্ধ, প্রতিবন্ধীদের রক্ষণাবেক্ষণ, ভরণপোষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাই সরকারি পরিকল্পনায়, প্রতিবেদন রচনায় নারীদের নাজুক হিসেবে নয় বরং তাদের ভূমিকার স্বীকৃতি দিয়ে, তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দুর্যোগ প্রশমনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

ড. মাহবুবা নাসরীন : অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও পরিচালক ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.