মাতৃত্বকালীন ছুটি ও বিশ্ববিদ্যালয় by শম্পা ইফতেখার

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী প্রজ্ঞাপন জারি করে সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসের ঘোষণা দিয়েছেন। এটি খুবই সুসংবাদ শিক্ষকতায় নিয়োজিত ওই সব মেয়ের জন্য, যারা মা হতে চলেছেন, যিনি জন্মদান-পরবর্তী সন্তানকে পরিপূর্ণ যত্ন করতে পারবেন।


অসংখ্য ধন্যবাদ এ প্রজ্ঞাপন জারির জন্য; কিন্তু আদেশ বা সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের যে অনীহা তা দিবালোকের মতোই সত্য। এ ক্ষেত্রে তার উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে। বাণিজ্যিক শহরগুলোয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে স্কুল প্রশাসন ইচ্ছামতো বিধিমালা করে, যা অনেকটা নিদ্বর্িধায় মেনে চলেন বেতনভুক্ত শিক্ষকরা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র অসন্তোষজনক না হলেও প্রীতিকর নয়।
ঢাকায় বেশকিছু স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মাতৃত্বকালীন ছুটি মাত্র ২ মাসের; অনেক ক্ষেত্রে তা বেতন ছাড়া। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একেক প্রতিষ্ঠানে একেক নিয়মনীতি ও ভিন্ন বিধিমালা। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ভিন্নতার জন্য এমন অবস্থা, যা অবস্থাদৃষ্টে স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধও বটে।
প্রজ্ঞাপনে যেভাবে বলা হয়েছে, শিক্ষয়িত্রী মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য যেদিন আবেদন করবেন সেদিন থেকেই তা কার্যকর করতে হবে_ এ আদেশের অসারতা ছোট একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেমিস্টার ভিত্তিতে কার্যক্রম চালায়। এ ক্ষেত্রে ৪, ক্ষেত্রবিশেষে ৬ মাসও সেমিস্টার হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি এক সেমিস্টারের। তার মানে চার মাসের। অনেক প্রতিষ্ঠান একটি সেমিস্টারের মাঝামাঝিতে ছুটি মঞ্জুরে অনীহা দেখায় নানা যুক্তিতে। ফলাফল বাচ্চা প্রসবের দিন যা-ই হোক পুরো সেমিস্টারের শুরুতে ছুটি নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে জন্মদান-পরবর্তী যদি সন্তানকে এক-দুই মাসের রেখে কাজে যোগদান করতে হয়, তা-ই করতে হবে। এ ধরনের ছুটি অনেক ক্ষেত্রে কাজেই আসে না_ না মায়ের, না নবজাতকের।
অন্যদিকে ছয় মাসের ছুটি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। চার মাসের ছুটি অনেক হিসাব কষে দেওয়া হয়। মাসকে অনেকে বা কিছু কর্তৃপক্ষ হিসাব করে ৩০ দিন ধরে। সে ক্ষেত্রে ছুটি হলো ১২০ দিনের। যদি কারও ছুটি সেমিস্টার অন্তে মাসের ২৮ তারিখে শেষ হয়, তবে ওই শিক্ষিকা ২৯ তারিখে যোগদান করবেন কার্যক্ষেত্রে। অর্জিত ছুটি বা অবৈতনিক ছুটি প্রয়োজনসাপেক্ষে নেওয়া যায়, যদিও এ ক্ষেত্রে শর্ত বা কিছু জটিলতা থাকে। আবার একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সব শিক্ষিকা সমানভাবে মূল্যায়িত না হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক, ডিপার্টমেন্টে ব্যক্তিগত অবস্থান ও প্রভাব_ অনেক কিছুই জড়িত এসব ছুটি পাওয়ার ক্ষেত্রে।
মাতৃত্বকালীন ছুটি তো আমাদের অধিকার, সুবিধা নয়। কোনো আনন্দ ভ্রমণের জন্য এ ছুটি নয়। একটি শিশু_ একটি ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্মোত্তর যে যত্ন তা মা ছাড়া আর কে পারে? তা ছাড়া মায়ের সুস্থতাও এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। একজন মায়ের দুগ্ধপোষ্য দু'এক মাসের শিশু সন্তানকে যখন যান্ত্রিক এ শহরে নিকটতম আত্মীয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহকর্মীর কাছে রেখে শ্রেণীতে পাঠদান করতে যান, তখন নিশ্চিতভাবেই মনস্তাত্তি্বক চাপে থাকেন, অপরাধবোধ কাজ করে। আর শিশুটি তার খাবারের জন্য নির্ভর করে ফর্মুলা দুধের ওপর, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ও মানবিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ছোট শিশুর সার্বক্ষণিক যত্নের জন্য মায়ের বিকল্প নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে যারা আছেন তারা জ্ঞানী ও সুবিবেচক_ এ বিশ্বাসে প্রত্যাশা করি মাতৃত্বকালীন ছুটি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবেন। ছয় মাসের ছুটি মায়ের মনস্তাত্তি্বক চাপ বা অপরাধবোধ নয়, বরং শিক্ষকের পেশাদারিত্ব, কর্মস্পৃহা, প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়িত্ব অনেকাংশে বাড়িয়ে দেবে। কারণ চিন্তামুক্ত, শর্তহীন যেটুকু সময় তিনি তার সন্তানকে দিচ্ছেন, প্রতিষ্ঠানেরই ইতিবাচক দিক তা নিদ্বর্িধায় বলা চলে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, শুধু প্রজ্ঞাপন জারি নয়, বাস্তবায়নে নজর দিন_ তদারকি করুন কোথায় তার ব্যত্যয় হচ্ছে। নতুবা আশা জাগানিয়া এ আদেশ শুধু ছাপার অক্ষর হয়ে থাকবে প্রহসনের দলিল হয়ে।

শম্পা ইফতেখার :শিক্ষক
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
sifta1979@yahoo.co.in

No comments

Powered by Blogger.