পুশকি ও তার বন্ধুরা by মাহবুব আশরাফ

নদীর ধারে যে গহিন বন, সেখানে গাছে গাছে হাজারো পাখির বাসা। কত শত রঙিন প্রজাপতি নেচে বেড়ায় সবুজ ঘাসের বুকে! খেলা করে রং-বেরঙের ফুলের গায়ে। সেই সবুজ বন থেকে ফুল তুলে আনে ছোট্ট মেয়ে পুশকি। সেই ফুল থেকে মালা বানিয়ে নিজের গলায় দেয় একটা, আর অন্যগুলো বিক্রি করে গাঁয়ের হাটে।


ফুল তুলতে গিয়ে পুশকি খেলা করে বনের পাখি আর প্রজাপতিদের সঙ্গে। পুশকির সঙ্গে খেলার জন্য ছুটে আসে হরিণ, খরগোশ, কাঠবিড়ালিসহ পশুর দলের সবাই। খেলা শেষে রঙিন পাখিদের পড়ে থাকা ঝলমলে পালক তুলে নেয় সে। সেই পালক দিয়ে ঝলমলে মুকুট বানিয়ে মাথায় পরে, আর কিছু পালক বিক্রি করে হাটে। ফুল আর পাখির পালক গাঁয়ের হাটে বেচে বেশ চলে যায় পুশকি আর তার মায়ের। রঙিন ফুলের মালা আর ঝলমলে মুকুট পরে ছোট্ট মেয়ে পুশকির দিনগুলো কেটে যায় আনন্দে।
একদিন রাজা এল বনে শিকার করতে। খুব পছন্দ হলো তার নদীর ধারের সেই সবুজ গহিন বন। মন্ত্রীকে হুকুম দিল নদীর ধারে রাজপ্রাসাদ বানাতে। হুকুম পেয়ে মন্ত্রী আর সেনার দল লেগে গেল প্রাসাদ বানাতে। নদীর ধারে পুশকিদের পাতার ছোট্ট কুঁড়েঘরটা দেখে তাদের সে কী রাগ! মন্ত্রী রেগেমেগে সেনাদের হুকুম দিল, ‘এক্ষুনি ভেঙে ফেল এই বিচ্ছিরি কুঁড়েঘর।’
মন্ত্রীমশাইয়ের হুংকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল পুশকি আর তার মা। ওদের দুজনকে তাড়িয়ে দিয়ে কুঁড়েঘরে আগুন ধরিয়ে দিল সেনারা। পুশকি আর তার মা মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে সবুজ বন ছেড়ে, নদী পেরিয়ে চলে গেল অনেক দূরের অন্য বনে। আর মন্ত্রী তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ইচ্ছেমতো বনের গাছ কাটতে শুরু করল প্রাসাদ বানানোর জন্য।
পরদিন বনের পশুপাখি সব অপেক্ষা করছে পুশকির সঙ্গে খেলার জন্য। প্রজাপতিরাও রঙিন ফুলে বসে আছে পুশকির জন্য। কিন্তু তার দেখা নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সবাই দোয়েল পাখিকে পাঠাল পুশকির খোঁজ নিতে। দোয়েল পাখি গিয়ে দেখে, পুশকিদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে সেখানে রাজপ্রাসাদ বানাচ্ছে সেনারা। পুশকি আর তার মায়ের দেখা নেই। দোয়েল সেনাদের কাছে জানতে চাইল পুশকির খবর। কিন্তু ওরা কিছু না বলে তাড়িয়ে দিল দোয়েলকে। দোয়েল গেল নদীর মাছের কাছে। নদীর মাছ দোয়েলকে জানাল, সেনারা পুশকিদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ওরা চলে গেছে নদীর অন্যপারের নতুন সবুজ বনে। দোয়েল ফিরে এসে সব জানাল বনের অন্য পশুপাখি আর প্রজাপতিদের। কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে বসল সবাই। অনেক কথার পর ঠিক হলো, পশুপাখি আর প্রজাপতির দলও চলে যাবে এ বন ছেড়ে। যেখানে পুশকি গেছে, সেই বনে গিয়ে থাকবে সবাই, খেলবে পুশকির সঙ্গে।
যেই কথা সেই কাজ। এ বন থেকে বিদায় নিল সব পশুপাখি আর প্রজাপতি। শূন্য বনে রঙিন ফুলেরা তখনো ফোটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে খেলার জন্য নেই কোনো প্রজাপতি। গাছের ডালে নতুন পাতারা আসে, কিন্তু সেই পাতার ছায়ায় বসে গান করে না কোনো পাখি।
এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। পুশকি নেই, প্রজাপতি নেই, পশুপাখিরাও নেই কেউ। তাই মনের দুঃখে ফুলেরাও আর ফোটে না। গাছের ডালেও আসে না আর নতুন কোনো পাতা। দেখতে দেখতে ঝরা পাতায় ঢেকে গেল বনের সবুজ ঘাসের মেঝে। ফুল আর পাতা ছাড়া গাছগুলোও সব ন্যাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তত দিনে সেনারা রাজপ্রাসাদ বানিয়ে শেষ করেছে। খবর পেয়ে ছুটে এল রাজা। সাত রানি এল পুশকির বয়সী রাজপুত্র আর রাজকন্যাদের নিয়ে। ওরা সবাই তো ভেবেছে, কত সুন্দর জায়গায় না জানি রাজপ্রাসাদ বানিয়েছে রাজা। কিন্তু এসে দেখে, রাজপ্রাসাদের চারদিকে শুধুই ন্যাড়া কতক গাছ আর ঝরে পড়া পচা পাতা। সবুজের কোনো চিহ্নই নেই। নেই কোনো প্রজাপতি, পশুপাখি। তাই দেখে রাজপুত্র আর রাজকন্যারা নাক সিটকিয়ে রাজাকে বলল, ‘আমরা এখানে থাকতে চাইনে।’ রানিদেরও পছন্দ হলো না এমন পচা জায়গা। তারা রাজপুত্র আর রাজকন্যাদের নিয়ে ফিরে চলল পুরোনো রাজপ্রাসাদে। এমন পচা জায়গা রাজারই বা ভালো লাগবে কেন! সেও ফিরে চলল রাজপুত্র আর রাজকন্যাদের পিছু পিছু। রাজার পেছনে চলল মন্ত্রী আর সেনার দল।
আর পুশকি?
নতুন সবুজ বনে প্রজাপতি আর পশুপাখি বন্ধুদের সঙ্গে সুখেই আছে সে। সেই বনে এখন আলো ঝলমল করে, ফোটে হাজারো রঙিন ফুল। গাছের ডালে রোজ আসে নতুন পাতা। সেই পাতার ছায়ায় বসে গান করে পাখির দল।

No comments

Powered by Blogger.