গোধূলির ছায়াপথে-বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে.. by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

তুমুল তর্ক বেধেছে, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে। তর্কের শেষ নেই। বিশ্বাসীরা প্রায়ই হেরে যাচ্ছেন। চাক্ষুষ প্রমাণ দানে অসমর্থ তাঁরা। একজন অবিশ্বাসী এসে জানালেন, ‘দল পরিবর্তন করছি।’ কোটরে বাসা বেঁধেছে যে কর্কট (ক্যানসার) রোগ, চিকিৎসকেরা মুখ কালো করে রায় দিয়েছেন, এ অসুখ সারার নয়। পেটের অংশ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে, মৃত্যু এসে আলিঙ্গন করবে সহসাই।


এরই মধ্যে পেলাম অভয় মন্ত্র। ভালো হয়ে যাব, তাঁর কথামতো চললে। এক মাস চলেছি কথামতো পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে। আমাকে দেখুন। ক্যানসার নেই, রেডিওলজি, এমআরআই টেস্ট বলছে, আমি ক্যানসারমুক্ত।
টাইম ম্যাগাজিনে বের হলে নড়েচড়ে বসেন সবাই। বলেন, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০০৯-এর পত্রিকাটি আপনার আছে? যেখানে জেফরি ক্লুগার ফেঁদেছেন প্রবন্ধ, নাম: দি বায়োলজি অব বিলিফ, বিজ্ঞান ও ধর্ম পরস্পরকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে পরাস্ত করে চলেছেন, তার খবর। এর পরই এলিস পার্কের ফোরাম: ফেইথ অ্যান্ড হিলিং। ক্যামব্রিজের ফেনোমনোলজি ইনস্টিটিউটে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, ফি-বছর আমন্ত্রণ পাই। দুই বছর পরপর ‘রিজন ও ফেইথ’ নিয়ে বিজ্ঞানীরা তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। হয়তো কোনো দিন যাওয়ার সুযোগ হবে, হয়তো হবে না।
মরণের পরে কি এ নিয়েই ভাবনা! চিকিৎসাশাস্ত্র ও ধর্ম দেহের যত্নের কথা বলে। চিকিৎসাশাস্ত্র মৃত্যুর পরবর্তী ভাবনা নিয়ে নিশ্চুপ, বিজ্ঞানও তা-ই। ইহুদিরা জীবনের পর সম্বন্ধে প্রায় কিছুই বলে না, বরং বলে, পৃথিবীটাকে ভালো করে ঝালিয়ে দেখো, যা কিছু এর মধ্যেই। খ্রিষ্টধর্ম দেখায় দোজখ ও বেহেশতের স্বপ্ন। ইসলামও তা-ই। বৌদ্ধরা দেখায় পুনর্জন্মের স্বপ্ন, সর্বশেষে নির্বাণ। হিন্দুত্ব শেখায় পুনর্জন্ম, কর্মশেষের পরিণতিতে। তাওইজম শেখায় জীবন ও মৃত্যুর সূত্র খুবই ক্ষীণ। বেহেশত ও দোজখ বলে কিছু নেই।
মস্তিষ্ক নিয়ে যত গবেষণা তার ছিটেফোঁটাও এসে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। শত বই বেরুচ্ছে বছরে মস্তিষ্ক নিয়ে নানা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে। বর্ডার্স ও বার্নস অ্যান্ড নোবেলে ভিড় করে আছেন উৎসাহীরা। ছয় হাজার রোগীর মধ্যে পরীক্ষা হয়েছে, মাঝেমধ্যে প্রার্থনায় অংশ নেন যাঁরা। কয়েক শ পৃষ্ঠা ফলাফল। বর্তমান নিবন্ধের জন্য অল্প একটু:
১. প্রার্থনালয়ে নিয়মিত যাতায়াতকারীদের আয়ুষ্কাল দুই থেকে তিন বছর বর্ধিত হয়েছে।
২. ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ৮২ জন কালো ব্যক্তি চার্চে যাতায়াত করেন। ৯২ জন কালো ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে ধর্ম তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয়। শতকরা ৫৫ জন সাদা ধর্মে বিশ্বাসী।
৩. উপবাস বা রোজায় অংশ নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য ফলাফল পাওয়া গেছে। নিষ্কৃতি পেয়েছেন ক্যালরি থেকে, প্রথম লিভারে, ফ্যাট ও প্রোটিন ডিপজিট থেকে। দেহের মস্তিষ্কের খাদ্য বন্ধ হওয়ার পর অন্য পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগের সম্ভাবনা খানিকটা হলেও উন্মুক্ত। ‘Disconnect, if you wish to connect with the other.’ মুঠোফোন নিবৃত্তির বিজ্ঞাপন নয়, ইন্দ্রিয়দ্বার বন্ধের ঘোষণা। ‘চন্দ্রমুখ’, আইপড, টিভি, সিনেমা, ধূমপানের মতো শত আয়োজন উপেক্ষা করো, দেহমনকে করো প্রস্তুত।
৪. পেটে খেলে এক রকম সয়, না খেলে অন্য রকম। ফলাফল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেনি। সবার জন্য ফলাফল এক। কেউ ভেবেছেন ভালো হতে হলে বিশ্বাসের কাছে যেতে হবে। অন্ধ বিশ্বাস। যাজকের কাজ হলো রোগীর বিশ্বাসের মান নির্ধারণ করা। যতটুকু বিশ্বাস ততটুকু ওষুধ, ততটুকু নিরাময়। সোজা ব্যাপার। বিশ্বাস ঈশ্বরের প্রতি যতটুকু নয়, তার চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যসেবার ওপর।
আফ্রিকায় খ্রিষ্টধর্মের সাফল্যের চাবিকাঠি প্রচারকদের নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্য পরিকল্পনা। দেশে দেশে পাদ্রিরা ছুটে গেছেন গভীরারণ্যে কুষ্ঠের সেবায়, পাহাড়ে পাহাড়ে ছুটে গেছেন ম্যালেরিয়ার সন্ধানে, গলগণ্ড, আর্সেনিকের সন্ধানে। তাবলিগরাও নেই পিছিয়ে। কাঁধে নিয়েছেন বায়োকেমিক, হোমিওপ্যাথি বড়ি ও পিতলের তাবিজ। দেহ একটি মন্দির, তার প্রয়োজন সুস্বাস্থ্য ও সুচেতনা।
জগতে এখন পাওয়া যাচ্ছে নানা নিরাময় কেন্দ্রের খবরাখবর। চিকিৎসক, মনোরোগ চিকিৎসক, ধর্মচারী, পবিত্র আবহ সৃষ্টিকারী প্রার্থনার শুভ নিয়ামক যেখানে একত্র হয়েছেন। তুরস্কে দেখে এসেছি দরবেশী নৃত্যের আয়োজন, পাহাড়ি উষ্ণ প্রস্রবণের পাদদেশে, প্রতি প্রাতে ইমামের শুভদৃষ্টি অসুখকে করে বিদূরিত। ‘সোহ্বৎ-ই-ফকির’ এই নিরাময় শর্তের অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের নবীজি চিকিৎসক ছিলেন না। সাধারণের জন্য ছিল তাঁর উপদেশাবলি। ‘সুস্থ জীবন ও সুস্থ পরিবেশ’ অধ্যায়ে ৭/৮ পৃষ্ঠা মুহাম্মদের [দ.] নাম গ্রন্থে। যখনই বৃষ্টি হতো বৃষ্টিতে ভিজতেন নবী। ‘একদিন হঠাৎ মেঘের বর্ষণ শুরু হলো। বর্ষার ঘনঘটা। পৃথিবী স্নাত হতে লাগল। নবীজি তাঁর পবিত্র সুন্দর গায়ের চাদর খুলে আল্লাহ্র করুণাধারাকে সমস্ত দেহমন দিয়ে উপভোগ করলেন। বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি। সর্বাঙ্গ ভিজে গেল বৃষ্টির জলে। একজন সাহাবী বললেন, ‘আপনি যে একেবারে ভিজে গেছেন।’ নবীজি বললেন: ‘ঠিক বলেছ, এ মেঘ যে আল্লাহ্র সৃষ্টি। এর বর্ষণ তো তাঁরই করুণাধারা। সিক্ত হয়ে ধন্য হলাম আমি।’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক ও সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.