খেসারত by আনোয়ার হোসেন

কাউকে কষ্ট দিলে নিজের ওপরও তা নেমে আসতে পারে_ এমন কথা বলা হয়। এমন কথাও তো আমরা জানি যে_ 'যাদের করেছ অপমান, অপমান হতে হয় তাদের সবার সমান।' এটাও বহুকালের পুরনো প্রবাদ বাক্য যে_ 'পাপ ছাড়ে না বাপকেও।'


পাকিস্তানের অধীনে ছিল বাংলাদেশ। সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রে এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা মিলেছিল তাদের। কিন্তু সামরিক জান্তা সিদ্ধান্ত নিল_ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করার জন্য তারা লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে সমাধির ব্যবস্থা করল। শুরু হলো বাংলাদেশে গণহত্যা। এ নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচার জন্য প্রায় এক কোটি নারী-পুরুষ-শিশু আশ্রয় নিল প্রতিবেশী দেশ ভারতে। আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে তাদের স্থান দেওয়া হলো। সে সময় ত্রিপুরার যত লোকসংখ্যা, এর চেয়ে বেশি হয়ে পড়ল বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থী। কলকাতার একটি অভিজাত এলাকার নাম এখন সল্ট লেক। সে সময় এর নাম ছিল লবণ হ্রদ। বাংলাদেশের কয়েক লাখ শরণার্থী জীবন বাঁচাতে লবণ হ্রদের তাঁবুসহ অন্যান্য জায়গায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের জন্য ভারত সরকার সাধ্যমতো সবকিছু করেছিল। এরপরও অনেক জীবন রক্ষা করা যায়নি। রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তারা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। অনেক নারীর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়। ৯ মাসের কঠিন জীবন শেষে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিরা ফিরে আসে হানাদারমুক্ত স্বদেশে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন সোমবার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় এখন শরণার্থী ও উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে সেই পাকিস্তানে, যারা একাত্তরে এক কোটি বাঙালিকে দেশছাড়া করেছিল। দেশের মধ্যেও অনেকে এখানে সেখানে অবস্থান নিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী পাকিস্তানে এখন উদ্বাস্তু ও শরণার্থী রয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ। এদের বড় অংশ এসেছে আফগানিস্তান থেকে। তা ছাড়া দেশটিতে উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির বেপরোয়া সন্ত্রাসের কারণেও অনেক মানুষ নিজের আবাসস্থল ছেড়ে অন্যত্র থাকতে বাধ্য হচ্ছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও বিবেকবান প্রতিটি মানুষই তাদের কাছে কাফের বা চরম শত্রু।
আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীরা পাকিস্তানের জন্য শুধু অর্থনৈতিক সমস্যাই সৃষ্টি করছে না, তাদের একটি অংশ সশস্ত্র হয়ে উঠে পাকিস্তানকেও বর্বর তালেবান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এখন প্রতিদিন পাকিস্তানের এক বা একাধিক স্থানে আত্মঘাতী কিংবা অন্য ধরনের ভয়ঙ্কর হামলা সংঘটিত হচ্ছে। মসজিদে নামাজরত মানুষের ওপরও নিক্ষেপ করা হচ্ছে বোমা ও গ্রেনেড। একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া নারী-পুরুষের প্রাণভিক্ষার আবেদনেও সাড়া দেয়নি। সম্প্রতি পাকিস্তানে একটি ভিডিওচিত্র নিয়ে তোলপাড় চলছে। এতে দেখা যায়, এক তরুণ নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছে। কিন্তু তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একাত্তরে বাংলাদেশে এমনটি ঘটেছে শহর-বন্দর-গ্রামের সর্বত্র। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে ওপরে ছুড়ে বেয়নেটবিদ্ধ করে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কত নারী তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। প্রতিদিন পাকিস্তানি সেনারা রুটিন করে হত্যা, লুটতরাজ ও অগি্নসংযোগ করেছে। বিশ্ববাসী এর সব খবর পায়নি। এখনকার মতো উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি থাকলে অনেক নৃশংসতার প্রামাণ্যচিত্র ক্যামেরাবন্দি হয়ে থাকত।
আমাদের এই সবুজ-শ্যামল প্রান্তরকে ওই হানাদাররা মানুষের রক্তে লাল করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন পাকিস্তান নিজের ঘরেই ডেকে এনেছে বিপদ। ভুল নীতির খেসারত যে দিতেই হয়।
 

No comments

Powered by Blogger.