কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন-মিনিকেটের গুমর ফাঁস by আবুল কাশেম

মিনিকেট চাল নিয়ে সন্দেহ, বিতর্ক অনেক দিনের। ঢাকাসহ দেশের অসংখ্য সচ্ছল পরিবারে ভাত খাওয়া হয় মিনিকেট চালের। এত মিনিকেট চাল আসে কোত্থেকে? মিনিকেট নামে কোনো ধান আদৌ আছে কি? এমন সব প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে। নানাজনে নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন।


অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মিনিকেট চালের গুমর ফাঁস করে দিয়েছে খোদ কৃষি মন্ত্রণালয়। তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, মোটা চাল আধুনিক মেশিনে চেঁছে চিকন করা হয়। পরে কৃত্রিমভাবে তা সাদা করে মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি করা হয়।
বছরের পর বছর ধরে ভোক্তারা মিনিকেটের দামে মোটা চাল নিয়ে ঘরে ফিরলেও এসব প্রতারণা বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর কোনো ভূমিকা নেই। অথচ ধান উৎপাদক হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্যমান নিশ্চিত করা যার দায়িত্ব, সেই খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায় প্রতারণা বন্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও মিনিকেট চালের এই গুমর সম্পর্কে নিশ্চিত।
গত ২৩ মে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এফএ-১ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শওকত আলী স্বাক্ষরিত মিনিকেট ধান ও চাল সম্পর্কে এক বিশদ প্রতিবেদন বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, 'মোটা-লম্বা জাতের ধান বিশেষ করে বিআর-২৮ জাতের ধান রাবার রোলারে ক্রাসিং করে মিনিকেট নামে বাজারজাত করছেন চালের মিল মালিকরা। অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রচুর পরিমাণ মিনিকেট চালের সরবরাহ লক্ষ্য করা গেলেও সব চাল আসল মিনিকেট নয়। সাধারণভাবে চাল দেখে বোঝা না গেলেও ভাত রান্নার পর আকৃতির ধরন দেখে বোঝা যায় এগুলো মিনিকেট নয়।'
কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, 'মিনিকেট চাল সরু বিধায় এ চাল দেশের উচ্চবিত্ত মহলে বেশ সমাদৃত। এ কারণে দিন দিন এ চালের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশের প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার চালের বাজারে মিনিকেটের বাজারই চার হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজারে যত চাল তার ২২ ভাগের এক ভাগই মিনিকেট নামে বিক্রি হচ্ছে। দেশের প্রায় ৭৫০টি চালকল 'মিনিকেট প্রক্রিয়া'র সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার ৩০০, নওগাঁর ৩০০, যশোরের ঝিকরগাছার ১০০ এবং রাজবাড়ীর ৫০টি মিল রয়েছে বলে জানা গেছে।
গত বছরের আগস্টে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে খাদ্য মন্ত্রণালয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলে, বাজারে যত মিনিকেট চাল পাওয়া যায়, এর এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ মিনিকেট ধানও দেশে উৎপাদিত হয় না। তা ছাড়া মিনিকেট বছরে একবারই উৎপাদন হয়। তাহলে সারা বছর এত মিনিকেট চাল আসে কোথা থেকে? একশ্রেণীর মিলমালিক আধুনিক মেশিনে মোটা চাল কেটে মিনিকেট নামে বিক্রি করছে। ক্রেতারাও মিনিকেটের নামে মোটা চাল কিনছে। এ প্রতারণা বন্ধ করতে তারা সুপারিশ করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে এ ধরনের 'নকল মিনিকেট' বিক্রি বন্ধে উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এটি তাদের কাজ নয় উল্লেখ করে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এটি খাদ্য মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্ব। তার পর থেকেই চুপ সরকারি প্রতিষ্ঠান। এমনকি প্রতিবেদন দেওয়ার আগে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ ধরনের কোনো মিল পরিদর্শনও করেনি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা উন্নত মানের মেশিনের মাধ্যমে তিন ধাপে মোটা চাল পলিস করে মিনিকেট তৈরি করা হয়। দেশে মিনিকেট ধান বেশি না হলেও এ ধরনের চাল সব দোকানেই পাওয়া যায়। যেসব মেশিনে চাল চিকন করা হয় তার ডায়াগ্রামও আমরা প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।' তিনি আরো বলেন, 'বিআর-২৮সহ এ ধরনের কিছু চাল এসব উন্নত মেশিনে মিনিকেটের রূপ দেওয়া হয়। এতে ডিসটিল্ড ওয়াটার ব্যবহার করে চালের চেহারা সাদা করা হয়। তবে এ চালের খাদ্যমান নির্ণয় করা আমাদের কাজ নয়। ধান উৎপাদন করে কৃষি মন্ত্রণালয়, আর খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের।'
মিনিকেট ধানের উৎপাদন ও এত বেশি চালের উৎস সম্পর্কে জানতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠানো হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, "বাংলাদেশে মিনিকেট নামে যে উফশী ধান বিভিন্ন অঞ্চলে কমবেশি চাষ হচ্ছে, তা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত বা অনুমোদিত কোনো জাত নয়। এটি ভারতীয় জাত। খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলা- যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, দিনাজপুর, রাজশাহী ও নওগাঁ অঞ্চলে ১৯৯০ সালের দিকে এ ধানের চাষ শুরু হয়। কৃষকরা নিজ উদ্যোগে সীমান্তের ওপারে থাকা আত্মীয়দের মাধ্যমে বোরো মৌসুমে ছোট ছোট প্যাকেটে মিনিকেট ধানের বীজ সংগ্রহ করে তা থেকে চারা তৈরি করে আবাদ করে। এ ধানের প্রকৃত নাম 'মিনিকিট'। বাংলাদেশে এটি 'মিনিকেট' নামে পরিচিতি পায়। অঞ্চলভেদে এ ধানের ফলন ৪ দশমিক ৮০ থেকে ৬ টন পর্যন্ত।"

No comments

Powered by Blogger.