শিক্ষা-শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সমাচার by আতাউর রহমান

পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন কত প্রতিবেদনই না বেরোয়! তন্মধ্যে কিছু প্রতিবেদন বেরোয় যেগুলো পাঠান্তে যুগপৎ বিস্মিত ও বিচলিত হতে হয়। তেমনই একটি প্রতিবেদন অতি সম্প্রতি বেরিয়েছে: রাজশাহী উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া ৮৩ জন প্রধান শিক্ষকের মধ্যে ৫৬ জনই ভুয়া হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।
অংশ নেওয়া কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থীর চলাফেরা, অসংলগ্ন আচরণ ও অনভিজ্ঞতাই নাকি অন্যদের মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি করে। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, এই রাজশাহীতেই ডাক বিভাগের একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ একাডেমি বিদ্যমান। সেখানে একবার একটি প্রশিক্ষণ-কোর্সে আফগানিস্তানের ডাক বিভাগ থেকে একজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে তাঁর মাতৃভাষা ফার্সি ব্যতিরেকে আর কোনো ভাষাই জানেন না; এমনকি ইংরেজি একটি শব্দও নয়। তিনি হোস্টেলে ও ক্লাসে সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে থাকতেন, মুখে হাসির চিহ্নমাত্রও দৃষ্টিগোচর হতো না। ঘটনাচক্রে আমি গেলাম ঢাকা থেকে ওখানে একটা ক্লাস নিতে। ক্লাসে তাঁর পরিচয় পেয়ে বাল্যকালে হাইস্কুলে ক্লাসিক ভাষা হিসেবে দুই বছর যে ফার্সি ভাষা পড়েছিলাম, স্মৃতি হাতড়িয়ে তার প্রয়োগে আমি সচেষ্ট হলাম। ফার্সিতে ‘নামে শোমা চিশ্ত’ অর্থাৎ আপনার নাম কী বলতেই তাঁর মুখে যে হাসির আভাটি ফুটে উঠল, সেটা দেখে বাংলাদেশি ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত তাঁর সহপ্রশিক্ষণার্থীরা বলতে লাগল, ‘এই প্রথম আমরা তাঁর মুখে হাসি দেখতে পেলাম।’ অতঃপর আমি যখন তাঁকে শোনালাম তাজমহলের দেয়ালে উৎকীর্ণ কথিত বাণী, ‘আগর ফেরদৌসে বরুইয়ে জমি আস্ত/হামি আস্ত, ও হামি আস্ত, ও হামি আস্ত (অর্থাৎ, পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে, তাহলে তা এখানেই এবং এখানেই এবং এখানেই)’, তখন তাঁর আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখে আমি মনে মনে ভাবছিলাম, তাহলে তাঁর দেশ তাঁকে বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠাল কেন!
সে যা হোক, ফিরে আসি শিক্ষকদের ব্যাপারটায়। নিন্দুকেরা নাকি বলেন, শিক্ষকতা হচ্ছে নিজে তেমন কিছু না জেনেই জ্ঞান বিতরণের আর্ট বা কলাকৌশল। তাঁরা আরও বলেন, শিক্ষকেরা হচ্ছেন দুনিয়াতে সর্বাধিক দায়িত্বপূর্ণ, সবচেয়ে কম বিজ্ঞাপিত, সর্বনিম্ন বেতনভোগী অথচ সবচেয়ে বেশি পুরস্কৃত পেশাজীবী। তা দুনিয়ার অন্যান্য দেশের বেলায় না হোক, আমাদের দেশের বেলায় কথাগুলো যে বহুলাংশে সত্যি, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে আমাদের রাজধানী শহরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বহু সম্মানিত শিক্ষক প্রতি মাসে প্রাইভেট পড়িয়ে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন, তাতে তাঁরা যে আক্ষরিক অর্থেই সবচেয়ে বেশি পুরস্কৃত, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধানমন্ডিতে আমার বাসার পাশে একটি কোচিং ক্লাস, সেখানে আগত ছাত্রছাত্রীদের গাড়ির ঠেলায় বিকেলে আমরা হাঁটতেও পারি না। আর আগেকার দিনে একজন তেজি তরুণ যখন হাইস্কুলের হেডমাস্টারের কামরায় যেত, তখন ভাবা হতো তার খবর আছে; এখনকার দিনে কোনো তেজি তরুণ যখন হেডমাস্টারের কামরায় যায়, তখন আশঙ্কা করা হয় হেডমাস্টার সাহেবের খবর আছে।
তো গরুকে নদীর তীরে নিয়ে যাওয়ার অনুরূপভাবে হয়ে যাক হাইস্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে কিছু খোশগল্প: তরুণ শিক্ষার্থী পরীক্ষার খাতায় শূন্য পেয়ে শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলছে, ‘স্যার, আমার বিশ্বাস হয় না যে আমি শূন্য পেতে পারি।’ তদুত্তরে গম্ভীর কণ্ঠে শিক্ষক বললেন, ‘তা আমি কী করব, এত্থেকে কম দেবার নিয়ম নেই যে!’ বারান্তরে শিক্ষক এক শিক্ষার্থীকে শোধালেন, ‘তুমি কি আমাকে শক্তির অপচয়ের একটি উদাহরণ দিতে পার?’ ‘পারি স্যার’, ছেলেটি চটপট উত্তর দিল, ‘একজন টাক-মাথা লোকের কাছে শুনলে ভয়ে মাথার চুল দাঁড়িয়ে যায় এমন একটি ভূতের গল্প বলা।’
আরও আছে। বার্ষিক পরীক্ষার ঠিক আগে প্রধান শিক্ষক দশম শ্রেণীর ক্লাস নিচ্ছিলেন। তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে বোঝালেন, পরীক্ষার আগে যে কয়দিন বাকি আছে, সে কয়দিন শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে।
পরিশেষে তিনি বললেন, ‘পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এখন ছাপাখানায়। কারও কোনো কিছু জানবার আছে কি?’
এক মিনিট নীরবতা। অতঃপর পেছনের দিক থেকে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আছে স্যার। ছাপাখানার নামটা জানা যাবে কি?’
আর আমাদের দেশের দশম শ্রেণীর এক ছাত্র যে স্কুল-পরিদর্শকের ‘সোমনাথের মন্দির কে ভেঙেছে?’ প্রশ্নের উত্তরে কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিয়েছিল, ‘আমি ভাঙিনি স্যার’ এবং ক্লাসটিচার থেকে শুরু করে হেডমাস্টার পর্যন্ত সবাই তার সাফাই গাইলেন, সেই গল্পটি বহুজন-কথিত ও বহুশ্রুত বিধায় এখানে আর বিস্তারিত বর্ণনায় গেলাম না।
তবে হ্যাঁ, দুই তরুণ শিক্ষার্থীর সেই গল্পটা বলতেই হয়: একজন অপরজনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘গত রাতে আমি একটুর জন্য বেঁচে গেছি।’ ‘কেন, কী হয়েছিল?’ শ্রোতা ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করল। ‘আর বলো না ভাই’, প্রথমজন এবার বলল, ‘আমি মাঝরাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে আমার কামরায় সাদামতো কিছু একটা দেখতে পেয়ে অন্ধকারেই চাকু ছুড়ে মেরে ওটাকে বিদ্ধ করলাম। অতঃপর বাতি জ্বালিয়ে দেখি, সেটা আমার শার্ট, যা সে দিন সন্ধ্যায় ধুয়ে আমি দেয়ালে হ্যাঙ্গারে টাঙিয়ে রেখেছিলাম।’
-তো তাতে একটুর জন্য বেঁচে যাওয়ার কী হলো, বুঝতে পারলাম না!
—আরে, বুঝলে না? ভেবে দেখো, যদি আমি গত রাতে শার্টটা গা থেকে খুলে রাখতে ভুলে যেতাম, তাহলে তো আমিও বিদ্ধ হতাম।
লেখাটা এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু ইতিমধ্যে এক বিরাট ব্যাপার ঘটে গেছে, আমাদের মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট জয় করে এসেছেন, সে জন্য রবীন্দ্র সরণিতে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। তো সংবর্ধনা-অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল সেই গল্পটি: দুই পর্বতারোহী বন্ধু রশি বেয়ে চূড়ায় উঠছিল। সে সময় নিচের বন্ধু ওপরের বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আমার ভয় হচ্ছে, হঠাৎ যদি রশি ছিঁড়ে যায়!’ ‘ভয়ের কিছু নেই’, উপরিস্থ বন্ধু জবাব দিল, ‘আমার ব্যাকপ্যাকে আরেকটা রশি আছে।’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক, ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.