মানবাধিকার-পুলিশও আইন এবং জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয় by সুলতানা কামাল

দায়িত্ব পালনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অবশ্যই শৃঙ্খলা, আইন এবং পেশাগত নীতি-নৈতিকতা মেনে চলা উচিত। এখানে সদস্যদের ব্যক্তিগত আচরণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীর নৈতিকতা ও শৃঙ্খলাপরায়ণতা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আচরণে জবাবদিহি ও শৃঙ্খলার কোনো লক্ষণ দেখতে পাই না। তাঁদের আচরণে নাগরিকদের প্রতি ন্যূনতম সৌজন্যবোধও নেই।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, আমরা পুলিশকে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দিইনি, সেই দায়িত্ব যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে, সে জন্য তাদের হাতে অস্ত্রও তুলে দিয়েছি। যে অস্ত্র জনগণের জানমাল রক্ষায় এবং অপরাধীদের ধরতে ব্যবহার করার কথা, সেই অস্ত্র যদি তারা নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে, সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। সংবিধান অনুযায়ী জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক। আর আমরা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকার, তার অধীন বাহিনী ও সংস্থাগুলোর হাতেই এই রাষ্ট্রের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়েছি। আইনের অধীনে থেকে তারা যার যার দায়িত্ব পালন করবে, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। আর অধীন বাহিনী ও সংস্থাগুলো সেই দায়িত্ব পালন করছে কি না, সেসব দেখা কিন্তু সরকারেরই কর্তব্য। সে ক্ষেত্রে একটি সরকারি বাহিনীর সদস্যরা যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বা সাধারণ নাগরিকের অধিকার হরণ করে, তার দায় সরকারও এড়াতে পারে না।
গত মঙ্গলবার আদালত প্রাঙ্গণে, বংশাল রোডে পুলিশ ক্লাবে ও কোতোয়ালি থানায় যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা যেমন পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলাবিরোধী, তেমনি মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব নাগরিকদের সম্মান ও অধিকার রক্ষা করা। সেখানে তাদের হাতেই যদি নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়, নারীরা লাঞ্ছিত হন, তাহলে মানুষের আশ্রয় বলে আর কিছু থাকে না।
পুলিশের কতিপয় সদস্যের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনৈতিক ও আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লে দেশে আইনের শাসন বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
গত মঙ্গলবার যে মেয়েটির ওপর পুলিশ নির্যাতন করেছে, তিনি আদালতে একটি মামলার প্রয়োজনে বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছিলেন। কিন্তু আদালত থেকে ফেরার পথে কে বা কারা ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করে আর পুলিশ মেয়েটির বাবার মোটরসাইকেল থামিয়ে তাঁকে মারধর করতে থাকে। স্বভাবতই মেয়েটি বাবাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন। এরপর পুলিশ মা-বাবা ও মেয়েটিকে পুলিশ ক্লাবে নিয়ে যায় এবং বাবার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। অন্যদিকে জামান ও পুলিশের আরেক সদস্য মেয়েটিকে একটি কক্ষে নিয়ে যৌন হয়রানি করে, তাঁর গলার হার ছিনিয়ে নিয়ে যায়। একটি আইনানুগ বাহিনীর সদস্যরা এই কাজ করতে পারে, ভাবতেও কষ্ট হয়। মেয়েটি পুলিশের নামফলক দেখেই জামানকে চিহ্নিত করেছেন। আরেকজনের নাম না বলতে পারলেও তার চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন। মেয়েটির হার ছিনিয়ে না নিলে কিংবা তিনি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত না হলে এভাবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতেন না।
মঙ্গলবার বিকেলে যখন এই ঘটনা ঘটে, আমি প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে ছিলাম। ইতিমধ্যে অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়, পুরান ঢাকায় পুলিশ একটি মেয়েকে তুলে নিয়েছে। আমরা যেহেতু মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, সেহেতু অনেকেই বিপদে পড়লে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরাও তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিতে চেষ্টা করি। ঘটনাটি ঘটেছে আদালতপাড়ায়। সেখানে অবস্থানরত আইনজীবীদের অনেকের কাছেই আমাদের সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নম্বর ছিল। তাঁরাই টেলিফোনে খবরটি প্রথমে অফিসে দেন এবং অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়।
অতীতে এ ধরনের অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। আমরা দিনাজপুরের ইয়াসমিনের ঘটনা জানি, তাঁকে পুলিশ ধর্ষণ ও হত্যা করে যৌনকর্মীর গল্প ফেঁদেছিল। চট্টগ্রামেও সীমা নামের একটি মেয়েও নিহত হয়েছিল। এসব কারণে ঘটনা শোনামাত্র আমি ঠিক করলাম, মেয়েটিকে আগে উদ্ধার করতে হবে। ইতিমধ্যে পুলিশ মেয়েটি ও তাঁর বাবা-মাকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেছে। সেখানে কয়েকজন আইনজীবী ও সাংবাদিককেও আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁরা মেয়েটির প্রতি পুলিশের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন। এ জন্য পুলিশ তাঁদের ওপরও নির্যাতন চালায়।
থানায় আমি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে জানতে চাই, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ? তিনি জানান, মেয়েটির বাবাকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে। আমি জানতে চাই, তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ আছে কি না? তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। আমি বললাম, যেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ নেই, সেহেতু তাঁদের ছেড়ে দিতে হবে। তাঁদের ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাব না। আমার অনড় অবস্থান দেখে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁদের ছেড়ে দিতে রাজি হন। তখন রাত ১০টা। আমি মেয়েটির বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে এলাম। কেননা, পুলিশ তাঁকে বেধড়ক পিটিয়েছে। তাঁর চোখে, ঘাড়ে ও হাতে-পায়ে আঘাতের চিহ্ন। মেয়েটি আমার কাছে অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাঁর বাবার চোখ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এটি বিপজ্জনক প্রবণতা। আমি আটক আইনজীবী ও সাংবাদিকদেরও ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলি। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাকে বললেন আইনজীবী সমিতির কর্মকর্তারা আসবেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে এদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পুলিশের এই আচরণ ছিল চরম অন্যায়। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে তাঁরা আইন তথা পেশাগত আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য। মানুষকে ব্যাটন দিয়ে আঘাত করা, গলা টিপে ধরা, চোখ তুলে নেওয়ার চেষ্টা কিংবা নারীদের যৌন হয়রানি করা কোনোভাবেই পুলিশের কাজ হতে পারে না।
একজন সাধারণ নাগরিকও যদি এ ধরনের আচরণ করে, সেটিও অপরাধ। কিন্তু আইন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্য হয়ে কেউ অন্যের অধিকার হরণ করলে তাঁর অপরাধ আরও গুরুতর বলে মনে করি। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের উদ্বেগের পেছনে কতগুলো বাস্তব কারণ আছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। এসব নিয়ে যখন আমরা পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি, তাঁরা দাবি করেন এর জন্য তাঁরা দায়ী নন। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তৃতীয় কোনো শক্তি এসব অঘটন ঘটাচ্ছে। কিন্তু পত্রিকা ও টেলিভিশনের ছবি ভিন্ন কথা বলে।
এর দুই দিন আগে প্রথম আলোর তিনজন সাংবাদিকের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায় পুলিশ। সেখানেও কিন্তু পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেয়েরা যে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছিল, সাংবাদিকেরা তার ছবি তুলছিলেন। পুলিশও তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিল, সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজ করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই পুলিশের সদস্যরা নিরীহ সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। আইনের মধ্যে থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের অধিকার সবার আছে। সেখানে পুলিশের চড়াও হওয়া বা অন্য নাগরিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
পুলিশ সদস্যদের যদি ন্যূনতম জবাবদিহি থাকত, আমার বিশ্বাস, তাঁরা এ কাজ করতে পারতেন না। পুলিশ বাহিনীতে আমাদের অনেক বন্ধু আছেন, দেশপ্রেমিক সদস্য আছেন। তাঁরা যদি এ বাহিনীতে আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারেন, তাহলে তাঁদের সেই ভালো থাকাও অর্থহীন হয়ে পড়বে।
সবশেষে আরেকটি বিষয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। অনেকেই অভিযোগ করেন পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহারের কারণেই তারা এমন এই বেপরোয়া ও বেআইনি আচরণ করছে। এটি যে বর্তমান সরকারের আমলেই ঘটছে, তা নয়; অতীতেও পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের বহু নজির রয়েছে। যাঁরাই ক্ষমতায় থাকুন না কেন, তাঁরা যদি পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকেন, এই বাহিনীর সদস্যরাও তখন সুযোগ নিতে চাইবেন। এ পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য যেমন বিপজ্জনক, আইনের শাসনের জন্যও কম ভয়ের কথা নয়।
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.