কিরগিজস্তান-মধ্য এশিয়ায় অস্থিতিশীলতার শুরু এখান থেকেই? by আহসান হাবীব

চলতি মাসে কিরগিজস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে সহিংসতায় প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট রোজা ওতুনবায়েভা। নিহতদের বেশির ভাগই উজবেক। আর হাজার হাজার উজবেক পালিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র উজবেকিস্তানে চলে গেছে।


সহিংসতাকালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন কর্তৃত্ব ছিল না, রাষ্ট্র সেখানে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। মধ্য এশিয়ার ভৌ-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার বিস্তার এখান থেকেই ঘটতে পারে।
এবারের সহিংসতার উৎস খুঁজতে গিয়ে বারবার ঘুরেফিরে আসছে সোভিয়েত নেতা যোসেফ স্টালিনের নাম। ১৯২০-এর দশকে তাঁর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে ফেরঘানা উপত্যকা ভাগ হয়ে যায় উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানের মধ্যে। ওলটপালট হয়ে যায় প্রজাতন্ত্রের সীমারেখা। ফলে, উজবেকপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ নগর অশ হয়ে ওঠে কিরগিজস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর। আর তাজিক সংস্কৃতির কেন্দ্র সমরখন্দ ও বোখারা পড়ে উজবেকিস্তানে।
ফেরঘানা উপত্যকায় জাতিগত সহিংসতা নতুন নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির আগে আগে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে ১৯৯০ সালে জাতিগত দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে সংখ্যালঘু উজবেকদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় রূপ নেয়। উজবেকপ্রধান এক যৌথ খামারের মালিকানাধীন জমি জোর করে স্থানীয় কিরগিজরা দখল করে নেওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল এই সহিংসতা। তিন-সপ্তাহব্যাপী সহিংসতায় নিহত হয় প্রায় এক হাজার মানুষ, যার বেশির ভাগ উজবেক। তবে এই সহিংসতার রাজনৈতিক প্রেক্ষিত ছিল সামান্যই।
কিরগিজস্তানে জাতিগত শুদ্ধির ঘটনাবলি যৌক্তিক সামরিক বা অর্থনৈতিক হিসাবনিকাশকে অতিক্রম করে গেছে। যদিও বলা হচ্ছে, জাতিগত দ্বন্দ্বই এই সহিংসতার কারণ। কিন্তু আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি এত সরল নয়। শুধু জাতিগত পার্থক্যের কারণে এমন সহিংসতা ঘটে না। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যারিম্যান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আলেকজান্ডার এ কুলে বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে এখানে দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত দ্বন্দ্ব বিরাজ করছিল।’ (নিউইয়র্ক টাইমস) উজবেক আর কিরগিজদের মধ্যে জাতিগত পার্থক্য এত সামান্য যে সহজে তাদের আলাদা করে শনাক্ত করতে পারা কঠিন। উভয় জাতিই প্রধানত মুসলমান; তুর্কিক ভাষায় কথা বলে এবং পরস্পরের কথা বুঝতে পারে।
অধিকাংশ জাতিগত সহিংসতায় শ্রেণী বৈষম্যকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। শোষিতের শ্রেণী অনুভবের স্থলে জায়গা করে নেয় জাতিগত বোধ। একটি আধিপত্যিক সমাজে যখন স্পষ্ট শোষণ থাকে, তখনই এমন বাস্তবতা তৈরি হয়। কিরগিজস্তানের কিরগিজ ও উজবেকদের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্যটা অর্থনৈতিক—কিরগিজরা ঐতিহ্যগতভাবে যাযাবর আর উজবেকরা কৃষক। এই পার্থক্য বর্তমান সময়ে এসে বড় শ্রেণীবৈষম্যে রূপ নিয়েছে। উজবেকরা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে; দক্ষিণ কিরগিজস্তানের বহু ব্যবসায়ের মালিক তারা। ফলে তাদের প্রতি কিরগিজদের মনে তিক্ততা জন্মেছে।
তবে শুধু বাজার বা পেশাগত পার্থক্যই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। কেননা, একচেটিয়ার প্রশ্ন যেখানে আসে, সেটা ভূমির মালিকানার প্রশ্নে হোক অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার, তখনই জাতিগত অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব অধিকতর গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। কিরগিজস্তানের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক দুগর্তির মধ্যে আছে। একের পর এক সরকারি দমননীতি তারা দেখেছে। চোখের সামনে প্রভাবশালীদের দুর্নীতিও অবাধে ঘটতে দেখেছে। আর এখন রাজনৈতিক ক্ষতের বিস্তৃতি ঘটছে। সহিংসতার এমন প্রাদুর্ভাব এসবেরই ফল। একদিকে দক্ষিণাঞ্চলে কিরগিজরা এপ্রিলের গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট কুরমানবেক বাকিয়েভের অনুগত। অন্যদিকে উজবেকরা নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক।
কিরগিজস্তানের অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে, এই সহিংসতা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। দুই মাস আগে ক্ষমতাসীন হওয়া সরকারের দুর্বলতার সুযোগে স্বার্থন্বেষী মহল, বিশেষ করে, দক্ষিণাঞ্চলে বাকিয়েভের সমর্থকেরা এই ঘটনার প্রধান উস্কানিদাতা। অবশ্য নির্বাসনে থাকা বাকিয়েভ এই সহিংসতার সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। উভয় দেশ মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিরগিজস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়ের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এই ছোট দেশটি দুই দেশের জন্যই কৌশলগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরো মধ্য এশিয়ার প্রাণভোমরা এখানে।
রাশিয়া ও পশ্চিমের ভয়, এই সহিংসতার কারণে এক শূন্যতা তৈরি হবে। রাষ্ট্র যে কতটা অকার্যকর তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই সুযোগে জঙ্গিবাদ ও সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র তাদের নিরাপদ আস্তানা গেড়ে বসবে। কিরগিজস্তান রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়তে থাকলে তা রাশিয়া ও চীনে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা এবং জাতিগত দ্বন্দ্ব বাড়াবে। পাশাপাশি উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও কাজাখস্তানের ওপর প্রভাব পড়বে। এই সংঘাতের তাৎপর্য কিরগিজস্তানের সীমান্তের মধ্যে আটকা থাকবে না। পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালানোর জন্য ন্যাটো বাহিনীকে সহায়তা ও সরঞ্জাম পাঠানোর জন্য মানাস সামরিক ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিরগিজস্তানে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক গোয়েন্দা উপস্থিতিও বাড়াতে চাচ্ছে। অশ শহরে সন্ত্রাসবাদবিরোধী একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে এ অঞ্চলে ন্যাটোর উপস্থিতি বাড়িয়ে চলেছে ওয়াশিংটন। কিন্তু আসল লক্ষ্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
কিরগিজস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দায় বৃহৎ শক্তিগুলো এড়াতে পারে না। অভিযোগ উঠেছে, কিরগিজ সেনাবাহিনী সহিংসতার সময় উজবেকদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। মাত্র কয়েক মাস আগে এই সেনাবাহিনীকে অর্থ ও প্রশিক্ষণের সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতায় থাকাকালে বাকিয়েভ যুক্তরাষ্ট্রের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। মানাস বিমানঘাঁটিতে সরঞ্জাম সরবরাহের বিশাল অঙ্কের ঠিকাদারি বাকিয়েভের ছেলে মাকসিমকে দিয়েছিল পেন্টাগন। বার বার দুর্নীতিপরায়ন শাসকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিবেচনা সামনে আসেনি। মধ্য এশিয়ার স্বৈরশাসকদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পেন্টাগন এই নীতিই অনুসরণ করছে।
নিরাপত্তার খাতিরে কিরগিজস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা বাড়তি কোনো দায় নিতে চায় না। তাই কিরগিজিস্তানের মানবিক সংকটের কথা তারা শুনছে না। কিরগিজ জনগণের দারিদ্র্য আর রাজনৈতিক ব্যবস্থা উন্নত করতে সহায়তার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। মধ্য এশিয়ায় মানবাধিকারের প্রশ্ন নয় তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাম্রাজ্যিক রাজনীতি।
এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বান সত্ত্বেও কিরগিজস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য রাশিয়া কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। রাশিয়ার কর্তৃত্বাধীন আঞ্চলিক নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থা কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অরগানাইজেশন (সিএসটিও) একটি শান্তিরক্ষী মিশন পাঠাতে একমত হতে পারেনি। আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো তারা শিক্ষা নিয়েছে। মস্কো শুধু ক্ষমতা আর প্রভাব চায়, কিন্তু কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।
কিরগিজস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে চীনেরও উদ্বেগ থাকার যথেষ্ঠ কারণ আছে। চীনের জিনজিয়ান প্রদেশের সঙ্গে কিরগিজস্তানের ৫৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত। জিনজিয়ান প্রদেশে গত বছর ব্যাপক দাঙ্গা হয়। সেখানকার মুসলমান উইঘুর জনগোষ্ঠী স্বাধীন রাষ্ট্র চায়। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তের খুব কাছে মার্কিন ঘাঁটি তাদের জন্য উদ্বেগজনক।
আহসান হাবীব: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.