ছাত্ররাজনীতি-কেমন ছাত্রলীগ চাই by মোঃ আল্লামা ইকবাল

গত ১১ বছরে কিছু পর্যবেক্ষণ তৈরি হয়েছে ছাত্রলীগকে নিয়ে। আমার মনে হয়েছে, একটি আদর্শিক সংগঠন হয়েও ছাত্রলীগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। ছাত্রলীগের কর্মীসংখ্যা কত এটা কেউ জানে না। একটি হলের সভাপতি হয়েও আমি জানি না হলের মোট কর্মীর সংখ্যা কত


শৈশবের দিনগুলোতে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল দেখেছি। না বুঝেই যোগ দিয়েছি মিছিলে। নৌকা নৌকা বলে চিৎকার করেছি। সবাই করত বলেই আমি করতাম। বাসায় রুমে রুমে ঘুরে ঘুরে নৌকার মিছিল করতাম। আমার বাবা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বলতেন, জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। আমার মিছিলে উৎসাহী হয়ে বাবা আমাকে পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ারটার কাছে নিয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছেড়ে শোনাতেন। এরপর কেটে যায় অনেক বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরই সক্রিয় হই রাজনীতিতে। স্বপ্নের ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে শুরু হয় পথচলা। বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসে বাবা আমার রাজনীতির খবর নেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখতে গিয়েছি কি-না, শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখেছি কি-না, শেখ হাসিনার বাড়ি দেখেছি কি-না, এসবই ছিল তার প্রথমদিকের জিজ্ঞাসা। এরপর বাড়তে থাকে বাবার প্রশ্নের পরিধি, বাড়তে থাকে আমার রাজনীতির বিস্তৃতি। পত্রিকায় ছাত্রলীগ নিয়ে সংবাদ দেখলেই উত্তেজনা নিয়ে তিনি ফোন করতেন। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে নয় বরং ছাত্র রাজনীতির দশা দেখে উৎকণ্ঠায়। তিনি তার ছেলেকে এ ছাত্রলীগে দেখতে চাননি। ছাত্রলীগের স্বর্ণর্োজ্জ্বল ইতিহাস মাথায় রেখেই তিনি তার ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। মনে পড়ে, সর্বশেষ ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করার পর বাবা আমার উচ্ছ্বাস নিয়ে ফোন করে বলেছিলেন, এ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা। ঠিকই ছাত্রদের হাতে ছাত্রলীগ তুলে দিলেন। কারও বিরোধিতাকে পরোয়া করলেন না। বাবা আজ বেঁচে নেই। এ বছরই তিনি চলে গেছেন। ভালোলাগা-ভালোবাসার ছাত্রলীগে ইতিমধ্যেই পার করে দিয়েছি ১১ বছর। তার হতাশাগুলো আমাকে ভাবিয়ে তোলে। মনে হয়, আমি নিজেও তো আসলে এ রকম ছাত্রলীগ চাইনি, যে ছাত্রলীগকে স্বীকৃতি দিতে সংকোচ বোধ করেন সবাই। জননেত্রী যার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। আওয়ামী লীগ যাদের দায় নিতে অস্বীকার করে। মনে পড়ে, জরুরি অবস্থায় জননেত্রীকে গ্রেফতার করার পরদিন ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলের কথা। আমরা কয়েকজন ছিলাম মাত্র সে মিছিলে। সেদিনও ছাত্রলীগের মিছিল দেখার পর অনেক ভেবেছি। এত বড় এক সংগঠনের এ অবস্থা হবে কেন? তারপর সরকার গঠনের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে শুধুই সংবাদপত্রে নেতিবাচক ছাত্রলীগ।
গত ১১ বছরে কিছু পর্যবেক্ষণ তৈরি হয়েছে ছাত্রলীগকে নিয়ে। আমার মনে হয়েছে, একটি আদর্শিক সংগঠন হয়েও ছাত্রলীগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। ছাত্রলীগের কর্মীসংখ্যা কত এটা কেউ জানে না। একটি হলের সভাপতি হয়েও আমি জানি না হলের মোট কর্মীর সংখ্যা কত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সদস্যসংখ্যাও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না অনেক কমিটির ক্ষেত্রে। সারাদেশে ছাত্রলীগে কী পরিমাণ নেতাকর্মী আছে তার কোনো হিসাব নেই। এর সুযোগ নেয় অন্যরা। অনুপ্রবেশ করে ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করে। কেন্দ্র থেকে এ অভিযোগ অনেকবার এসেছে কিন্তু শনাক্ত করা যায়নি। কারণ ছাত্রলীগের নেই নির্দিষ্ট কোনো ডাটাবেজ। অথচ এটা কঠিন কোনো কাজ নয়। ছাত্রলীগের সব ইউনিট কমিটি পারে তাদের সাব ইউনিট থেকে তালিকা সংগ্রহ করতে। এর মাধ্যমে সারাদেশের ছাত্রলীগের সব কমিটির সদস্য তালিকা কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা যায় একটি সার্ভারের মাধ্যমে। এমনকি ছাত্রলীগের ওয়েবসাইটে তা দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। প্রত্যেকটা কমিটি নিজ নিজ এলাকায় কর্মী সংগ্রহ করবে, তাদের তালিকায় আনা হবে। প্রত্যেক কমিটির নেতারা তাদের সদস্যদের দায়দায়িত্ব বহন করবে। তাতে করে ছাত্রলীগের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তা শনাক্ত করা যাবে। এতে করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। বোঝা যাবে ছাত্রলীগের শক্তিমত্তা।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের জন্য অবশ্য পাঠ্য কিছু বইয়ের তালিকা তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস জানতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনার ইতিহাস জানতে হবে। আওয়ামী লীগের ইতিহাস জানতে হবে। ছাত্রলীগের ইতিহাস জানতে হবে। দেশের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন ধারণা থাকতে হবে। বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
ছাত্রলীগ তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বল্গগ চালু করবে। সবাই বল্গগিং করবে। রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরবে। ফেসবুক, টুইটারসহ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর মাধ্যমে দেশ-বিদেশে অন্তরঙ্গতা তৈরি করব্, øে8;ংগঠনের প্রচার চালাবে। দলের সঠিক নীতির পক্ষে জনসচেতনতা বাড়াবে।
এর জন্য আলাদা কোনো বাজেট দরকার নেই। আলাদা লোকবল দরকার নেই। কারণ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রলীগ এতে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই প্রয়োজন উদ্যোগ, প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ দিয়ে মেডিকেল টিম গঠন করা যেতে পারে। যাদের কাজ হবে দেশ সফর করা। চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ দিয়ে শিক্ষা টিম করা। যারা দেশ ঘুরে ঘুরে অবহেলিত শিশুদের শিক্ষা দেবে। নিরক্ষর মানুষকে স্বাক্ষরতা শেখাবে। দেশে দুর্যোগ দেখা দিলে টিম গঠন করে দুর্যোগ এলাকায় চলে যাবে, মানুষের পাশে দাঁড়াবে। ত্রাণ সরবরাহ করবে। স্বেচ্ছাসেবী হবে।
ছাত্রলীগ থেকে শুধু নেতা তৈরি হবে না; তৈরি হবে আমলা, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, করপোরেট চাকরিজীবী। মেধাবী শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগ প্রয়োজনে স্কলারশিপ পেতে সাহায্য করবে। বিদেশ পাঠিয়ে উচ্চ শিক্ষায় সাহায্য করবে। বিদেশি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলবে। মতবিনিময় করবে। তাদের দেশে ডাকবে। ছাত্রলীগ বিদেশ সফর করবে। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে। দেশকে ছড়িয়ে দেবে সারাবিশ্বে।
ছাত্রলীগে ফুটবল দল থাকবে, ক্রিকেট দল থাকবে, বিতর্ক দল থাকবে, সাংস্কৃতিক দল থাকবে। ছাত্রলীগ হয়ে উঠবে জাতির জনক বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ছাত্রলীগ। তারা নিজেরা স্বপ্ন দেখবে, অন্যদের স্বপ্ন দেখাবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আলোকিত জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা।

মোঃ আল্লামা ইকবাল : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, অমর একুশে হল শাখা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.