হাওর-দ্রুত নদী খনন, বাঁধ উঁচুকরণ জরুরি

গত কয়েক মাস ধরে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট হাওর অঞ্চলে অকালবন্যা-পরিস্থিতি, এর কারণ ও প্রতিক্রিয়া, প্রিয় পাঠক, বিভিন্ন গণমাধ্যমে আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন। সেসব প্রতিবেদন দেখে সম্প্রতি নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলি উপজেলার ছাতিরচর, শিংপুর, কামারপাশা, দামপাড়া ইউনিয়ন,


সুনামগঞ্জ জেলার গাইল্লার হাওর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের রউয়া, বইশমারা, চিলাইন পয়েন্ট, চরমোলা ইউনিয়ন, পাগলা ইউনিয়নের কান্তলং, জয়কলস ইউনিয়নের খাইক্যারপাড় প্রভৃতি গ্রাম পরিদর্শন করি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকারপ্রতিনিধি, ওই অঞ্চলের সাংসদ, গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি। সরকারি হিসাবমতে, এবারের বন্যায় ৬১ শতাংশ জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, এর পরিমাণ ৭৫ শতাংশেরও বেশি। এবারের বন্যার ক্ষতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। হাওর অঞ্চলের প্রবীণ অধিবাসীদের মতে, এবারের বন্যার বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যতিক্রমী। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবমতে, গত বন্যার তুলনায় এবার হাওরে পানি বেড়েছে ১.৪ সেন্টিমিটার। এর আগেও হাওরের ফসল অকালবন্যায় ডুবেছে। কিন্তু এবারের ঢল আর ফসলডুবি একেবারেই অন্য রকম। অসময়ে এত পানি দেখেনি কৃষক। এ রকম সর্বস্বও কখনো খোয়া যায়নি তাদের। হাওরে সাধারণত পাহাড়ি ঢল নামে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এ সময়টায় ফসল অনেকটা পেকে যায়। কৃষকেরা তাদের ফসল বেশির ভাগ গোলায় তুলতে পারে, যা দিয়ে বছরের বাকিটা সময় চলে যায়। কিন্তু হঠাৎ করেই এবার মার্চের শেষ সপ্তাহে হাওরে পাহাড়ি ঢল নামে। তখন হাওরজুড়ে কাঁচা সবুজ ধানের শীষ। কাঁচি লাগানোর কোনো সুযোগ ছিল না। চোখের সামনে সব ফসল তলিয়ে গেছে। ভেঙে গেছে কৃষকের স্বপ্ন-সাধ। অনিশ্চয়তার পড়েছে জীবন-জীবিকা।
অফুরন্ত সম্ভাবনার বিপরীতে অগণিত সমস্যার আবর্তে আবদ্ধ এখন বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল। এখানকার ভূ-প্রকৃতি, জনজীবনের সংকট, প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, পেশা, অর্থনীতি, সমস্যা ও সম্ভাবনা দেশের বাকি অঞ্চলের চেয়ে ভিন্নতর, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এ অঞ্চলের বিপুল সম্পদ অব্যবহূত, এখানকার লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য অবহেলায় বিনষ্ট হয়, অথচ লাখ লাখ মানুষ থাকে কর্মহীন, বঞ্চিত, দুস্থ ও অভাবী। হাওর অঞ্চলের উন্নয়নে দ্রুত ও জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত ও সুষম পরিকল্পনা গ্রহণে বিশেষ পদক্ষেপের প্রয়োজন অনুভূত হলেও তা এযাবৎ কখনোই অনুসৃত হয়নি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এই সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলার ২০ হাজার ২২ বর্গকিমি এলাকার দুই হাজার ৪১৭ বর্গকিমিজুড়ে হাওরের অবস্থান। সাত জেলার দুই কোটি মানুষের আনুমানিক ১০ শতাংশ হাওরে বসবাস করে। তবে এর আশপাশের বিপুল জনগোষ্ঠীও হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাওরের ভূমির উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে চার মিটার উঁচু আর সুনামগঞ্জ এলাকার উচ্চতা মাত্র দুই মিটার। ফলে এখানের ভূমি অধিকাংশ সময়ে পানির নিচে তলিয়ে থাকে। এই অঞ্চলের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ পানিকে কেন্দ্র করে। এ ছাড়া এই অঞ্চলের মানুষের কর্মহীনতাকেও এক ধরনের বিপর্যয়। হাওর অঞ্চলে প্রতিবছর কার্তিক ও চৈত্র মাসে মঙ্গা-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এখানে কাজের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া সম্প্রতি নদীভাঙন নতুন এক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর হাওরবাসী যে ফসল বোনে তা সব সময় ঘরে তুলতে পারে না। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল—এই ১০ বছরের মধ্যে মাত্র পাঁচ বছর হাওরবাসী তাদের ফসল ঘরে তুলতে পেরেছে।
হাওরে এখন ফসলহারা কৃষকদের করুণ আর্তনাদ আর আহাজারি। সর্বনাশা ঢলের পানি আর কৃষকের চোখের জল সেখানে মিলেমিশে একাকার। কারণ এই ফসলের ওপরই পরিবারের খাওয়াদাওয়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বিয়েশাদি, আনন্দ-উৎসব সবই নির্ভর করে। তবে এবারের বন্যায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। সেটি হলো, হাওরের কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমে ফসল রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা। সব শ্রেণী-পেশার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর বাঁধ রক্ষায় নিজেরাই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। যখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পালিয়ে গেছে, তখন স্থানীয় এসব মানুষ কারও অপেক্ষায় না থেকে নিজেদের উদ্যোগে রাত-দিন বাঁধ নির্মাণ আর মেরামত করেছে। সে কারণে বাঁধ নির্মাণে হাওরপারের মানুষজনকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি এবার সামনে চলে এসেছে। দাবি উঠেছে, ভবিষ্যতে স্থানীয় ঠিকাদারদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণকে কাজে সম্পৃক্ত করার।
শুধু হাওরে বাঁধ দিয়ে আর ফসল রক্ষা করা যাবে না—এর ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে হাওরপারের মানুষেরা। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে পলি-বালি এসে হাওরের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৪ সালে এক রিপোর্টে জানায়, সুনামগঞ্জ জেলার ৩০টি নদী পাহাড়ি ঢলের করণে নাব্যতা হারিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আটটি সীমান্ত নদী ভারতের খাসিয়া পাহাড় থেকে প্রবাহিত হওয়ায় বর্ষা মৌসুমের পাহাড়ি ঢলে দিন দিন পলি ও বালুতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কমে গেছে নদীর পানির ধারণক্ষমতা। ফলে উজানে বৃষ্টি হলে প্রচুর পরিমাণে ঢল নামে। আর এই ঢলের পানি নদীগুলো ধারণ করতে না পারায় তীর উপচে ঢুকে পড়ে হাওরে। হাওরের বাঁধ নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। কিন্তু স্থানীয় মানুষ, জনপ্রতিনিধি আর অধিকারকর্মীদের অভিযোগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে আইলা-দুর্গত, ভবদহের জলাবদ্ধ কিংবা হাওরের সর্বস্বান্ত কৃষকের মতো সারা দেশের মানুষের অন্তহীন অভিযোগ। এই অভিযোগ তাদের কাজের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি নিয়ে। বাঁধ নির্মাণে পাউবো কর্মকর্তা আর ঠিকাদারেরা মিলে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। অকালবন্যা থেকে হাওরের ফসল রক্ষার জন্য প্রতিবছর অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। আর এই বাঁধ নির্মাণ করে থাকে স্থানীয় পাউবো। বাঁধ নির্মিত হয় প্রতিবছর, দুর্নীতিও হয় প্রতিবছর। ঠিকাদার আর পাউবোর কর্মকর্তারা মিলে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি করে থাকে। এটা যেমন হাওরপারের মানুষজন জানে, তেমনি সরকারের সব পর্যায়েই এটা জানা আছে। কিন্তু এই অনিয়ম-দুর্নীতি রোধের কোনো চেষ্টা কোনোকালে হয়েছে বলে বোঝা যায় না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? আমাদের দাবি: এক. হাওরের অকালবন্যা থেকে হাওরের মানুষ, সম্পদ বাঁচাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিশেষজ্ঞ ও হাওরে বসবাসরত মানুষদের পরামর্শ হলো, হাওরের বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে হবে। পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীসহ সুরমা, কুশিয়ারা, কালনী, মনু নদী নিয়মিত খনন করতে হবে। দুই. নদী খনন যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাঁধের উচ্চতাও বাড়াতে হবে। এ জন্য নতুনভাবে বাঁধের উচ্চতা নির্ধারণ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে বাঁধ সংস্কারের সব অব্যবস্থাপনা। পৌষ-মাঘ মাসের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করতে হবে। তিন. হাওরে আগাম পাকে এমন ধানের জাত লাগাতে হবে। কমপক্ষে ফসলকে ১৫ দিন এগিয়ে আনতে হবে। এ জন্য কৃষি গবেষকদের এগিয়ে আসতে হবে। চার. হাওরকে এ বছরের জন্য দুর্গত এলাকা ঘোষণা, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে সচল করা, সব উন্নয়নকাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত এবং এনজিও ও কৃষি ব্যাংকের ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত করতে হবে।
লেখকবৃন্দ: মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, পানি-প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.