কালের পুরাণ-বাড়াবাড়ির হরতাল, কাড়াকাড়ির রাজনীতি by সোহরাব হাসান

রোববারের হরতালে যে দুই পক্ষই বাড়াবাড়ি করেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রথম হরতাল নিয়ে বিরোধী দল বিএনপি ছিল মহা উদ্বেগের মধ্যে। হরতাল সফল করতে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যেকোনো মূল্যে হরতাল সফল করে তুলতেই হবে। এ কারণেই দলীয় নেতারা পাড়ায় পাড়ায় গণসংযোগ করেছেন।


বিনম্র কণ্ঠে শ্রমজীবী মানুষকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেছেন। প্রচারপত্র বিলি করে হরতালের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও ক্ষমতায় থাকতে আমরা তাঁদের অন্য চেহারা দেখেছি। সে সময় বিএনপির নেতারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন, এখন বিনয়ের অবতার সেজেছেন। আর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের নেতারাও দ্রুত অতীত ভুলে গেছেন। কথায় কথায় রণহুঙ্কার ছাড়ছেন।
হরতাল নিয়ে সরকারি দলের উদ্বেগও কম ছিল না। মহাজোটের আকাশছোঁয়া জনসমর্থনে সামান্য ঘাটতি পড়েছে, সেটি মানা যায় না। কয়েক দিন আগে থেকেই মন্ত্রীরা হরতালের বিরুদ্ধে জোর গলায় প্রচার চালাতে থাকলেন। টিভির সংবাদে, টক শোতে হরতালের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ প্রচার হতে থাকল। এসব প্রচারণা বিএনপিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। কিন্তু তার পরও সম্ভবত হরতাল আহ্বানকারীদের কেউ কেউ নিশ্চিত হতে পারেননি। তাঁরা মধ্যরাতে গাড়ি ভাঙচুর করে, বাসে আগুন জ্বালিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। ফলে হরতালটি আর শান্তিপূর্ণ থাকেনি।
সরকারের মন্ত্রীরা, সরকারি দলের নেতারাও দাবি করেছিলেন, তাঁরা বিরোধী দলকে বাধা দেবেন না। দলীয় কর্মীদের রাস্তায় নামাবেন না। তবে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় যা করণীয়, প্রশাসন তা-ই করবে। কেউ জোর করে দোকান বা গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাধা দেবে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘কেউ কথা রাখেনি’। না সরকারি দল, না বিরোধী দল। এতে তাদের গোঁয়ার্তুমি বহাল রয়েছে বটে; ক্ষতি হয়েছে দেশের, জনগণের। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে শায়েস্তা করছে, দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। আর সাধারণ মানুষের আতঙ্ক বাড়ছে। আবার কি আমরা হরতাল-যুগে ফিরে আসছি? আবার কি রাস্তাঘাটে বেঘোরে মানুষ মারা যাবে? আবার কি রাজপথে আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া চলতে থাকবে?
রোববারের হরতালটি সারা দেশে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ থাকলেও হঠাৎ ঢাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল কেন? এর পেছনে কি শুধু দুই দলের অতি-উৎসাহীরা সক্রিয় ছিল, না অন্য কোনো মহল? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, তাঁরা দলীয় কর্মীদের রাস্তায় নামাবেন না। তার পরও ছাত্রলীগ কেন রাস্তায় নামল? কে তাদের নামাল? বিএনপির নেতারাও বলেছিলেন, হরতাল শান্তিপূর্ণ হবে। কিন্তু মধ্যরাতে কারা গাড়ি ভাঙচুর করল? কারা গাড়িতে আগুন লাগাল?
শোনা যায়, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। কর্মীরাও নেতাদের কথা শোনেন না। নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মিল নেই। একেকজন একেক কথা বলেন। তাহলে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে কে? রাজনীতিকেরা, নাকি অন্য কেউ? দেশের রাজনীতি সুস্থ থাকলে যাঁদের গুরুত্ব থাকে না, গণতন্ত্র সচল থাকলে যাঁরা অপাঙেক্তয় হয়ে যান, তাঁরাই কি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন? নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতেই কি মধ্যরাতে গাড়িতে আগুন দেওয়া হলো? বিরোধী দলের সমাবেশে হামলা চালানো হলো? শাহবাগ ও বাড্ডায় ছাত্রলীগের কর্মীরা কার নির্দেশে হরতাল-সমর্থকদের ওপর হামলা চালালেন? সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেননি। শাহবাগে হামলার ঘটনায় বিএনপির কর্মীরা আসামি হলে ছাত্রলীগকে বাদ দেওয়া হলো কেন? সেখানে পিকেটিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী। তিনি কেবল বিএনপির নেতা নন, সাংসদও। একজন সাংসদের নিরাপত্তা দেওয়া কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব নয়? তারা সে দায়িত্ব পালন না করে তাঁকে যেভাবে টেনেহিঁচড়ে হাসপাতাল থেকে গাড়িতে তুলে নিল, তা কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না। এভাবে আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির সাংসদেরা এবং বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের সাংসদেরা লাঞ্ছিত হবেন? এই গণতন্ত্রই কি আমরা চেয়েছিলাম?
ছাত্রলীগের হামলায় শহীদ উদ্দীন চৌধুরী আহত হলে বিএনপির কর্মীরাও পাল্টা হামলা করেন, পরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গেও তাঁদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ কোনো পক্ষকে নিবৃত্ত না করে হরতালের সমর্থক নেতা-কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ছাড়া র‌্যাবের সদস্যরা বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসের বাড়িতে ঢুকে যেভাবে সেখানে আশ্রয় গ্রহণকারী নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তা লজ্জাজনক।
হরতালে এই প্রথম র‌্যাব নামানো হলো। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ নেতারা র‌্যাবকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করতেন। এখন একই কাজ তাঁরাও করছেন। তাহলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য কোথায়? বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের রাস্তায় লাঠিপেটা করে র‌্যাব-পুলিশ হাতের সুখ মেটালেও সরকারের লাভ হয়নি। হরতালে সংঘাত-সংঘর্ষ না হলে বিরোধী দলের বলার কিছু থাকত না। প্রতিবাদে নতুন কর্মসূচি নিতে পারত না। এখন তারা সংসদে যাওয়ার জন্য নতুন দাবিনামা পেশ করেছে। অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, সরকার সে দাবি মানবে না। বিরোধী দল সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আবার হরতাল ডাকবে। আবার সংঘাত-সংঘর্ষ হবে। আবার গাড়ি ভাঙচুর করা হবে। আবার পুলিশ লাঠিপেটা করবে। আবার বিরোধী দল নতুন দাবিনামা পেশ করবে। চক্রাকারে এটি চলতেই থাকবে?
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আরেকটু সতর্ক হতে পারতেন। এর মাধ্যমে তিনি পরোক্ষভাবে হলেও তাঁদের বাড়াবাড়ির কথা স্বীকার করেছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেছেন, বিএনপি নেতার বাড়িতে ঢুকে পুলিশ বা র‌্যাব যা করেছে, তা নিন্দনীয়। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এ কাজ করতে পারে না। তবুও করেছে। সরকার কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে?
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মির্জা আব্বাসের বাসায় গেছেন সেখানে আহত ব্যক্তিদের দেখতে। কিন্তু তিনি শনিবার রাতে গাড়িতে বিএনপির কর্মীদের অগ্নিসংযোগে আহত গাড়িচালক ও তাঁর সহযোগীকে দেখতে যাননি। দেখতে যাননি হরতাল পালনকারীদের ইটের আঘাতে গুরুতর আহত গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীকে। কেন? সরকারের মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের দেখতে গেছেন। কিন্তু বিএনপির আহত সাংসদ ও নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে একটি কথা বলেননি।
স্পিকার আবদুল হামিদ সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী চিকিৎসার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা যা-ই থাক না কেন, সবার আগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যথার্থ বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। আরও ভালো হতো যদি স্পিকার আহত সাংসদকে হাসপাতালে দেখতে যেতেন। একজন সাংসদের প্রতি স্পিকারের দায়িত্ব আছে। দায়িত্ব আছে সংসদ নেত্রীরও। রাজনীতিকে সুস্থ রাখতে হলে সরকার ও দলকে আলাদা রাখতে হবে। অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে পারেন, বিএনপির আমলেও তাঁদের সাংসদদের লাঠিপেটা করা হয়েছিল। বিএনপি করেছিল বলে আওয়ামী লীগেরও একই কাজ করতে হবে?
হরতালের ‘সাফল্য’ ও ‘অসাফল্য’ নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা যখন বাহাস করছেন তখন সিলেট, রংপুর ও কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যায় প্লাবিত, লাখ লাখ মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। এর আগে বন্যায় হাওর এলাকার ফসল ভেসে গেছে, আইলা-আক্রান্ত মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। তাদের কথা কেউ ভাবছেন না। এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও জার্মানির সেমিফাইনালে ওঠার যেমন সম্ভাবনা নেই, তেমনি আওয়ামী লীগ, বিএনপিও একসঙ্গে থাকতে পারবে না। এক দল সংসদে থাকলে আরেক দল রাজপথে। অন্যান্য দেশের গণতন্ত্র হলো একযোগে কাজ করা, পরস্পরকে সহায়তা করা, জাতীয় স্বার্থে একমত হওয়া। আমাদের দেশে গণতন্ত্র হলো নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ। নিজের গুণকীর্তনের পাশাপাশি অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া। ক্ষমতায় থাকতে সবকিছু দখল করে নেওয়া এবং বিরোধী দলে থাকতে পরের বার দখলের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। আর তার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয় রাজপথকে। জনজীবনে বিপর্যয় আসুক, দেশ গোল্লায় যাক, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। তাদের একটাই লক্ষ্য—ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতার জন্য মারামারি, ক্ষমতার জন্য কাড়াকাড়ি। যে পুলিশ এখন শহীদ উদ্দিন চৌধুরী ও মির্জা আব্বাসকে লাঠিপেটা করেছে, বিএনপির আমলে সেই পুলিশই নাসিম-মায়াদের ঠেঙিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারে আছে, মহা প্রতাপে দেশ চালাচ্ছে। কিন্তু দল কতটা আছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আওয়ামী লীগ যা বলে, ছাত্রলীগ শোনে না; আর নেতারা যা বলেন, কর্মীরা মানেন না। জেলায় জেলায় নেতাদের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ আছে। আছে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। কিন্তু সেসব মেটানোর কোনো উদ্যোগ নেই। দল কীভাবে চলছে, তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয়ে ব্যস্ত, সাংসদেরা তদবিরবাজিতে। মন্ত্রী না হতে পারা নেতারা মনোবেদনায় ভুগছেন। মাঝে মাঝে ক্ষুব্ধও হচ্ছেন। ওই পর্যন্তই।
হরতালে দুই পক্ষই বাড়াবাড়ি করেছে। এটি আমাদের অসহিষ্ণু রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। কেউ কাউকে সহ্য করছে না। ক্ষমতাসীনেরা মনে করে, যেহেতু থানা-পুলিশ-র‌্যাব-বিডিআর তাদের হাতে আছে, অতএব বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন নেই। আর বিরোধী দল মনে করে, সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনের জবাব তারা রাজপথেই দেবে, সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সরকার যা করবে তার বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে হবে, উন্নয়ন ব্যাহত করতে হবে। মানুষের কষ্ট হয় হোক, দেশ রসাতলে যায় যাক, ক্ষমতার সোনার হরিণ তার পেতেই হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.