চলতি পথে-পথ আর অন্ধকারের পাঁচালি by দীপংকর চন্দ

সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ। অন্ধকার নেমেছে চরাচরে। শম্ভুগঞ্জ সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে সম্ভাব্য গল্প রচনার বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবছিলাম আমরা। না, ব্রহ্মপুত্র নদের করুণ পরিণতি নিয়ে নয়, আজ গল্প রচনা করব অন্ধকার নিয়ে। কিন্তু অন্ধকার নিয়ে কি কোনো গল্প রচনা সম্ভব আদৌ? চেষ্টা করতে দোষ কি! সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই দূরে তাকালাম আমরা।


হ্যাঁ, ব্রহ্মপুত্র নদের দূর পারের ওই দিকরেখায় ঝুলে থাকা অন্ধকার বেশ ঘন। অন্যদিকে শম্ভুগঞ্জ সেতুর পাদদেশে গড়ে ওঠা বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে অন্ধকার নেই বললেই চলে। সন্ধ্যা হতে না-হতেই বেরসিকভাবে জ্বলে ওঠা সড়কবাতিগুলোর কারণেই অন্ধকার জমে ওঠার সুযোগই পায়নি এখানে। না, অন্ধকার নিয়ে গল্প রচনা সহজ নয় মোটেই। আচ্ছা, অন্ধকারের সঙ্গে যদি জুড়ে দিই পথের পাঁচালি! পথ আর অন্ধকার মিলেমিশে কি দাঁড়াবে না গল্পটা? ভাবতে ভাবতে আমরা ঘুরে দাঁড়ালাম। এগোলাম হট্টগোলে পূর্ণ বাসস্ট্যান্ডের দিকে। একটা সাধারণ মানের বাস দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডের প্রবেশপথে। বাস সহকারীর ভাষ্যে, বিরিশিরি যাওয়ার শেষ বাস এটাই।
‘কতক্ষণ লাগবে বিরিশিরি পৌঁছাতে?’ জানতে চাইলাম আমরা।
‘এক ঘণ্টা ২০ মিনিট।’ উত্তর দিলেন বাস সহকারী।
এত কম সময়! সন্দেহ হলো আমাদের। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি সত্যিই বিরিশিরি পর্যন্ত যাবে তো বাস?
বাস সহকারী এবার দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। বলবেন কি বলবেন না ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললেন শেষ পর্যন্ত, না, বিরিশিরি পর্যন্ত যাবে না বাস, পথে একটা সেতু ভাঙা। তাই বাস যাবে সেই ভাঙা সেতু পর্যন্ত।
‘ভাঙা সেতু থেকে বিরিশিরির দূরত্ব কত?’
‘অল্প। হেঁটে সেতুর ভাঙ্গা এলাকাটা পার হলেই বাস, টেম্পু, রিকশা পাবেন। সেগুলোর কোনো একটাতে চেপে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারবেন বিরিশিরি।’
বাস সহকারীর কথায় আশ্বস্ত হতে পারলেন না ময়মনসিংহের স্থায়ী বাসিন্দা নীতিশদা। এ অঞ্চলের পথঘাট, বাস পরিষেবার মান সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তাঁর। তিনি তাঁর আতিথ্যে রাতটুকু কাটিয়ে আগামী প্রত্যুষে বিরিশিরি যাওয়ার উপদেশ দিলেন আমাদের। কিন্তু আমরা তাঁর উপদেশের গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হলাম; বাসভর্তি যাত্রীদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রওনা হলাম।
বাস ছাড়ল। শহর ছাড়তে না-ছাড়তেই বাসের জানালায় জমাটবদ্ধ হলো অন্ধকার। শহরের সঙ্গে বাসের দূরত্ব যত বাড়ল, পাল্লা দিয়ে ততই বদলাল অন্ধকারের রং। কালো, কালো থেকে ঘন কালো, কখনো বা কালোর পরিমাণ ভীষণ রকম বেশি। তারপর অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করল হঠাৎ; ফিকে হতে হতে অল্প সময়ের জন্য হারিয়েও গেল একরাশ আলোর মাঝে। ছোট একটা বাজার। বাস থামল, যাত্রীর ওঠানামা। আবার পথ চলা। বিভিন্ন হাট-বাজার ছুঁয়ে ছুঁয়ে এভাবেই চলতে লাগল বাস। এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের পথ দুই ঘণ্টা ৪০ মিনিটেরও বেশি সময় পার হওয়ার পর স্তব্ধ হলো বাসের গতি। কী ব্যাপার? জানা গেল, সামনেই ভাঙা সেতু। সুতরাং আমরা বাস থেকে নেমে এলাম মাটিতে। মাটিতে পা রাখতে না-রাখতেই ঘন কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার গ্রাস করে নিল আমাদের। বিস্ময়ে আমরা তাকালাম এদিক-ওদিক! না, বিস্তীর্ণ চরাচরে আলো নেই কোনো! অন্ধকার, কেবলই অন্ধকার!
‘কী নাম এই জায়গাটির?’ জানতে চাইলাম ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলা সহযাত্রীদের কাছে।
‘বালুঘাটা।’ দ্রুত উত্তর দিলেন একজন।
পাকা সড়কের ঢাল বেয়ে মেঠো পথে নামলাম আমরা। ডান পাশে ভাঙা সেতুটির লোহার কাঠামো কাত হয়ে পড়ে আছে। সেতুর অংশটুকু পার হয়ে অক্লেশেই উঠে এলাম ওপারে। কিন্তু কোথায় বাস, টেম্পো কিংবা রিকশা? বিরিশিরি যাওয়ার বিকল্প কোনো যানবাহনই যে নেই সেখানে! নীতিশদার কথা মনে পড়ল আমাদের, মনে পড়ল তাঁর উপদেশমূলক বাক্যগুলো। হায়! এখন উপায়?
‘সামনেই একটা বাজার আছে। সেখানে গেলে যানবাহনের একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে!’ সামান্য আশার কথা শোনালেন আমাদের এক সহযাত্রী। তাতেই উদ্দীপ্ত হলাম আমরা। হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাইলাম, ‘কী নাম সেই বাজারের?’
‘জারিয়া’
জারিয়া! নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলায় অবস্থিত জারিয়া নামের এই অঞ্চলটিতেই একটি বধ্যভূমির জন্ম দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। রাতের অন্ধকারে সেই বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে বহু বাঙালিকে হত্যা করেছে তারা। তারপর ভাসিয়ে দিয়েছে কংশ নদীর জলে। সেই শোকেই কি অন্ধকার এখানে ঘন কৃষ্ণবর্ণ? ভাবতে ভাবতে সামনে এগোই আমরা। তবে মনের ভেতর অজানা শক্তির অনুভব এখন। জানি এই অন্ধকার কেটে যাবে নিশ্চিত। বহু শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার মতোই আমাদের হাতেও নিশ্চিত ধরা দেবে অধরা গন্তব্য।

No comments

Powered by Blogger.