কলকাতার চিঠি-পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে পা by অমর সাহা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকার ৩৩ বছর পার করে ২১ জুন পা দিয়েছে ৩৪ বছরে। একটানা ক্ষমতায় থাকার এই অনন্য নজির বামফ্রন্ট সৃষ্টি করলেও আজ আর একদণ্ড শান্তিতে নেই বামফ্রন্ট। অক্টোপাশের মতো চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে বিরোধীরা।


২০০৬ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের মধ্যে ২৩৫টি ছিনিয়ে নেয়, তখন হয়তো তারাও ভাবতে পারেনি তাদের জন্য ২০১১ সালের নির্বাচনে অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ পরিণতি। ২০০৬ সালের নির্বাচনে যেভাবে বামফ্রন্টের পক্ষে জোয়ার বইছিল, তখন বামফ্রন্টের নেতারা আশা করেছিলেন ২০১১ কেন, আরও এক যুগেও বামফ্রন্টকে গদিচ্যুৎ করার মতো শক্তি সঞ্চার করতে পারবে না কোনো দলই। কারণ, জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে গেছে। তৈরি হয়েছে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর তৃণমূলকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে।
এর পরই ২০০৭ সাল থেকে রাজ্যব্যাপী পরিবর্তনের ঝড় তুললেন মমতা। শুরু হলো বামফ্রন্টবিরোধী ঝড়। সেই ঝড় ২০১০ সালে আরও বেগবান হয়ে আঘাত করতে শুরু করে গোটা পশ্চিমবঙ্গে। ২০১১ সালে এই ঝড় যে নিদারুণ বেগে আঘাত করবে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের সাজানো বাগানে, তা বামফ্রন্টের নেতারা ইতিমধ্যেই আঁচ করতে পেরেছেন। এই ঝড়ের বেগ দেখে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী শক্তির আধার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা দিয়েছেন, মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে বামফ্রন্টের। এখন শুধু অপেক্ষা সময়ের। কিন্তু কেন এমনটা হলো? এই নিয়ে গোটা ভারতেরই রাজনৈতিক বিশ্লেষণের অন্ত নেই।
সেই ১৯৭৭ সালে কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু কংগ্রেসের সে সময়কার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন, তখন হয়তো বামফ্রন্ট ভাবতেও পারেনি, তারা একটানা ৩৩ বছর শাসন করতে পারবে পশ্চিমবঙ্গকে। কিন্তু পেরেছে। পেরেছে তাদের জনমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বামফ্রন্ট স্বমহিমায় শাসন করে গেছে রাজ্যকে।
বামফ্রন্টের বিপর্যয় শুরু হয় ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে। এই নির্বাচনেই প্রথম ধস নামে বামফ্রন্টে। গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪১ হাজার ৫০৪ আসনের মধ্যে তৃণমূল পায় নয় হাজার ৩৭৫টি আসন। যদিও বামফ্রন্ট জয়ী হয় ২১ হাজার ৬৯১টি আসনে, এখান থেকেই শুরু হয় মমতার জয়যাত্রা। তারপর ২০০৯ সালের ভারতের পার্লামেন্ট বা লোকসভার নির্বাচনে মমতা পান বিপুল জয়। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ছিনিয়ে নেয় ১৯টি আসন। এবার ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত হয় কলকাতা পৌর করপোরেশনসহ রাজ্যের ৮১টি পৌরসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনেও মমতা ধস নামিয়ে দেন বামফ্রন্ট-শিবিরে। এই জয়যাত্রা দেখে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও নিশ্চিত, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জিততে চলেছেন মমতা। তিনিই হবেন পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী।
মূলত মমতার আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলনই মমতাকে রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করে আপসহীন এক নেত্রী হিসেবে। হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটার এক লাখি গাড়ি কারখানা নির্মাণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার টাটাকে ৯৯৭ একর জমি দেয়। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ওই জমিতে বেড়া দিতে যায় টাটা। আর তখনই এই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন মমতা। এই আন্দোলনের জেরে মমতা ২৫ দিন অনশনও করেন। মমতার দাবি, কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অনিচ্ছুক কৃষকদের সেই জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলনের মুখে পড়ে টাটা এই রাজ্য ছেড়ে চলেও যায়। এখন অবশ্য গুজরাটের সানন্দে গড়ে তোলা হয়েছে ন্যানো গাড়ির কারখানা।
এর পরের ঘটনা নন্দীগ্রামের। পূর্ব মেদিনীপুরের এই নন্দীগ্রামে রাজ্য সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার জন্য উদ্যোগ নিলে ফের রুখে দাঁড়ান মমতা। গড়ে তোলেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। চলে আন্দোলন। যদিও নন্দীগ্রামে রাজ্য সরকার কোনো জমি অধিগ্রহণ করেনি, কেবল ঘোষণা দেওয়ার পরই শুরু হয় এই আন্দোলন। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে ঘটে গণহত্যার ঘটনা। এদিন আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় নিহত হয় ১৪ গ্রামবাসী। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে। চাঙা হয়ে যায় মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। এই দুটি আন্দোলনের মধ্যেই ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই নির্বাচনেই প্রথম ধস নামে বামফ্রন্টে।
সেই ধসের পালা এখনো চলছে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টে। কিন্তু কেন এই ধস? কী কারণে মানুষ এত বিক্ষুব্ধ হয়েছে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে, তাই নিয়ে বিতর্কের অভাব নেই। তবে সাধারণ মানুষের ভাষ্য এরকম, ‘আমরা মমতাকে চিনি না। আমরা চাই একটু পরিবর্তন। চাই ৩৩ বছরের একটানা শাসনের অবসান। একঘেয়েমি থেকে মুক্তি চাই। নতুন কিছু দেখতে চাই।’ আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘না ভাই, সিপিএমের দম্ভ বেড়ে গেছে। আমরা মানি, সিপিএমের ভূমি সংস্কারনীতি এবং পঞ্চায়েতব্যবস্থাই এই রাজ্যে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। কিন্তু শেষ দিকে সিপিএমের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব আর দম্ভই মানুষকে সিপিএমের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’
সবশেষে বামফ্রন্টের শরিক ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখাটির ইতি টানছি। তিনি বলেছেন, ‘২০০৬ সালে আমরা ২৯৪ আসনের মধ্যে ২৩৫টি পেয়ে আনন্দের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম বিরোধীদের চেয়ে আমাদের ভোটের ব্যবধান মাত্র এক শতাংশেরও কম। গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই বামফ্রন্ট সরকার পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়ে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বামফ্রন্টের যেসব সিদ্ধান্ত মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, তার পেছনে বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিএমের অবদানই বেশি। আমরা সমাজতন্ত্রের কথা বললেও এই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করা উচিত, তা আমরা করি না। পরিবর্তে যুগ যুগ ধরে ভ্রষ্টাচারের রাজনীতিকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাই। এই যে রাজনৈতিক চতুরালি, এ থেকেই জন্ম নিয়েছে বামপন্থীদের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। তার ফল তো ফলবেই।’
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.