আলোর ইশারা-জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনার হালহকিকত by আইনুন নিশাত

গত শুক্রবার শেষ হলো জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনার সর্বশেষ সভা। ১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা ক্লাইমেট চেঞ্জ কনভেনশন নামে পরিচিত, তার সব সদস্যের অংশগ্রহণে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে প্রধান সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সভাকে বলা হয় কনফারেন্স অব পার্টিজ।
এতে বিশ্বের সব দেশ সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করে থাকে। ১৩ নম্বর সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালি শহরে। ওই সভায় বালি অ্যাকশন প্ল্যান নামে যে পরিকল্পনাটি প্রণীত হয়, তা অবলম্বনে বিশ্বের জন্য নতুন একটি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়; যার ভিত্তি হবে পাঁচটি স্তম্ভ। স্তম্ভগুলো হলো_ ১. লং টার্ম ভিশন বা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা; ২. মিটিগেশন বা উষ্ণতা বাড়ার জন্য দায়ী গ্যাসগুলোর উদগিরণ কমানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; ৩. অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য আরও বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ; ৪. ওপরের তিনটি কাজ করতে গেলে যে তহবিল প্রয়োজন হবে সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ এবং ৫. প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ, যাতে করে মিটিগেশন ও অ্যাডাপটেশন বাস্তবায়িত হতে পারে।
আশা ছিল দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত ১৫তম কনফারেন্স অব পার্টিজে এ বিষয়ে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়ন সম্পন্ন হবে। কিন্তু ওই সম্মেলনে এ ধরনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি যেসব সিদ্ধান্ত সেখানে নেওয়া হয়েছিল তাও প্রথাগত ত্রুটির কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর এক বছর পর মেক্সিকোর কানকুন শহরে অনুষ্ঠিত হলো ষোলোতম কনফারেন্স অব পার্টিজ। এখানে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তা মোটামুটি কোপেনহেগেন সিদ্ধান্তের কাছাকাছি। তবে বালি অ্যাকশন প্ল্যান পুরোপুরি কার্যকর হতে আরও সময় লাগবে। ২০১০ সালে কানকুনে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিতব্য ১৭তম কনফারেন্স অব পার্টিজে এ কাজ সম্পন্ন হবে।
ডারবান কনফারেন্স অব পার্টিজের প্রস্তুতি পর্যায়ে মাস দুয়েক আগে ব্যাংককে সপ্তাহব্যাপী একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর গত সপ্তাহে শেষ হলো ব্যাংকক-পরবর্তী সভা; যার মেয়াদ ছিল দু'সপ্তাহের বেশি। ডিসেম্বর ২০১১ সালের আগে হয়তো আরও একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। হয়তো এটি হবে পানামা নগরীতে। কিন্তু ২০০৭ সালে বালি থেকে যে আশার কথা শুনে দেশে ফিরেছিলাম, সেই আশার শিখা ধীরে ধীরে ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে। ২০১১ সালে কতদূর এগোনো যাবে সে বিষয়ে অনেক সন্দেহ জন্মেছে। গত সপ্তাহের বন সভায় কিছু অগ্রগতি লক্ষ্য করলেও বহু বিষয়ে বিভিন্ন দেশের পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং নিজ অবস্থানে অনড় থাকায় আমরা শঙ্কাবোধ করছি।
এ প্রেক্ষাপটে আজকের লেখায় আলোচনার ধারা সম্পর্কে বলতে চাই। বলতে চাই, আমরা কোথায় এগোচ্ছি, কোথায় পিছিয়ে যাচ্ছি। কোপেনহেগেন বা কানকুনের মতো সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে এ কলামে আগেই লিখেছি। কিছু ক্ষেত্রে যাদের অযৌক্তিক অবস্থানের কারণে আলোচনা প্রায় বানচাল হতে চলেছে তাও বলব আজকে। প্রথমে বলা যাক জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পদ্ধতির বিষয়ে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম প্রধান। কোনো কোনো গবষকের হিসাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। এই ঝুঁকির পরিমাণ নিরূপণে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলছে। বন সম্মেলনে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি সঞ্চালক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের এই নির্বাচন অত্যন্ত অর্থবহ। কারণ আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি ও প্রয়োজনীয় বিষয় এটি। এ বিষয়ে আমাদের শঙ্কার কথা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা প্রয়োজন, যাতে করে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার সময় আমরা অগ্রাধিকার পাই। তবে এ বিষয়ে আলোচনা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আশা করব বাংলাদেশের প্রতিনিধির তৎপরতায় এ বিষয়ের আলোচনা গতিময়তা পাবে।
আরেকটি বিষয় তুলে ধরি। বিশ্বের কয়েকটি দেশ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়ার অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়তে পারে মনে করে বিশেষ হৈচৈ করে থাকে। এরা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের তেল রফতানিকারক দেশ। গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে হলে পেট্রোল বা ডিজেলের ব্যবহার কমাতে হবে নিশ্চিত। অর্থাৎ পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানির ব্যবহার কমানোর জন্য সচেষ্ট হবে সমগ্র বিশ্ব। এতে পেট্রোল রফতানিকারক দেশগুলো আশঙ্কা করছে, তাদের আয় কমে যাবে। তারা এখন হৈচৈ শুরু করেছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারণ, তারা গরিব হয়ে যেতে পারে। আমার কাছে বিষয়টি প্রায় হাস্যকর মনে হয়। তেল বিক্রির অর্থে যারা বিলাস-ব্যসনে জীবন কাটাচ্ছে, তারা সারা দুনিয়ার কাছে আবেদন করছে ক্ষতিপূরণের। যেসব দেশ তেলের দাম আকাশছোঁয়া করে বিশ্ব অর্থনীতিকে বিভিন্ন সময়ে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে চলছে; তারা বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর প্রক্রিয়ায় বাধা দিচ্ছে তাদের বিলাসবহুল জীবনের কথা চিন্তা করে। আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় অনুন্নত দেশগুলোকে তথা সব উন্নয়নশীল দেশকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার কথা বললেই তেলসমৃদ্ধ ওই দেশগুলো তাদের ভবিষ্যতের উৎকণ্ঠায় পুরো প্রক্রিয়া বানচালে উদ্যোগী হতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
বন সভায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে। বাস্তবে কতটুকু কাজ হবে জানি না; কিন্তু এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে গভীর আলোচনা হয়েছে। এখানে অবশ্য উন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বেশকিছু মতপার্থক্য রয়েছে। উন্নত দেশগুলো চাইছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে প্রযুক্তি হস্তান্তরের কাজটি সম্পন্ন করা হোক। আর পুরো কাজটি ওই সংস্থার হাতেই ছেড়ে দেওয়া হোক। উন্নয়নশীল দেশগুলোর এ বিষয়ে ততটা আপত্তি নেই; কিন্তু আপত্তি হচ্ছে সার্বিক সিদ্ধান্তের দায়িত্বে কারা থাকবেন সেটা নিয়ে। তাদের বক্তব্য, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিত্বমূলক কমিটির মাধ্যমে কাজটি করা হোক। উন্নত দেশগুলোর আপত্তি হলো, এ প্রক্রিয়ায় যেসব প্রতিনিধির নাম প্রস্তাব করা হচ্ছে, তারা বিশেষজ্ঞ নন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এ কাজ চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমঝোতার ক্ষেত্রে দেড় বছর খুব বেশি সময় নয়। প্রযুক্তিগতভাবে আমরা যদি বিশ্বের কাছ থেকে সহায়তা পেতে চাই, তাহলে এখনই আমাদের তৎপর হতে হবে।
আমি জানি, বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে আমাদের প্রযুক্তি বিষয়ে চাহিদা নিরূপণের কাজ হাতে নিয়েছে। দরকার হচ্ছে একই সঙ্গে একটি অ্যাকশন প্ল্যান নিরূপণ। এ কাজটি করবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত চাহিদা নিরূপণ তথা প্রযুক্তি অ্যাকশন প্ল্যানের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে বোধকরি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় বোর্ড, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন, শিল্প মন্ত্রণালয়, খাদ্য ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ববস্থাপনা ব্যুরো, আবহাওয়া অধিদফতর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইত্যদি। পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে তৎপর কিন্তু বাকি মন্ত্রণালয় বা দফতরগুলোকে অবিলম্বে সজাগ করে তোলা উচিত। এ দায়িত্ব কে নেবে, তার উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে অবহিত আছেন লক্ষ্য করছি। আশা করছি, তারা যথোপযুক্ত প্রযুক্তি আহরণের বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন।
অর্থায়নের কথা দিয়ে আমার লেখা শেষ করব। কানকুন সম্মেলনে বিশ্ব তিন বছরের মধ্যে ৩০ বিলিয়ন ডলার জোগান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০২০ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ানোর কথা প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারে। এই অর্থ সাহায্য বিদ্যমান উন্নয়ন সহযোগিতার অতিরিক্ত। ইতিমধ্যে এই টাকা বিতরণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কী হবে, তার রূপরেখা চূড়ান্ত হয়েছে। এর ভিত্তিতেই বিস্তারিত প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ চলছে। যে কমিটি এ কাজ করছে, বাংলাদেশ তার সদস্য। সবসময় বলে আসা হচ্ছে যে, দেশগুলো সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা পাবে। অর্থাৎ অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় দাতা দেশ বা সংস্থা এবং গ্রহীতা দেশের মধ্যে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অবস্থান থাকবে না। এখানেই জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো দেখানোর চেষ্টা করছে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অনুন্নত দেশগুলোতে দক্ষতার অভাব, অর্থ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাবে সরাসরি অর্থায়ন যথার্থ হবে না। অর্থাৎ তারা চাইছে বিশ্বব্যাংক কিংবা ইউএনডিপির মধ্যে অর্থায়নের কাজটি সম্পন্ন করতে। এতে করে বাংলাদেশের মতো দেশ, যারা বিশ্বব্যাংকের আধিপত্য মানতে রাজি হয়নি, তাদের কোণঠাসা করা যাবে। গত দু'বছরে ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের কর্তৃত্ব মানেনি। বিষয়টি প্রশংসনীয় এবং সরকারের এ সাহসের কাজটি সারাবিশ্বে আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে। এমন বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ধারা যাতে বজায় থাকে, সে বিষয়ে সরকার দৃঢ় অবস্থান নিতে চাইলে আমাদের অবশ্যই অদক্ষতা ও অস্বচ্ছতা বিষয়ক সমালোচনার জবাব বের করতে হবে। প্রয়োজনবোধে ঔপনিবেশিক আমল থেকে প্রচলিত পদ্ধতিগুলো পর্যালোচনা করে সময়োপযোগী করতে হবে।
বন সম্মেলনে লক্ষ্য করেছি, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বহু অনুন্নত দেশ বহু প্রকল্পে অর্থানুকূল্য পেয়েছে। আমরা বোধহয় একটু পেছনে পড়ে যাচ্ছি। আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে দোষারোপ করে উন্নত দেশগুলো যদি এ কাজ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, অতি সম্প্রতি ফিলিপাইন সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যথোপযুক্ত পরিবর্তন এনেছে।
আজকের লেখা শেষ করছি এ কথা বলে, জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তন মোকাবেলায় সমন্বিতভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে বৈশ্বিক পর্যায়ে অনেক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, এসবে আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অব্যাহত থাকবেই আশা করি।

অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত : পরিবেশ বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.