বাঘা তেঁতুল-হরতাল, পুলিশ ও নারী by সৈয়দ আবুল মকসুদ

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উপমহাদেশে প্রথম হরতাল পালিত হয় মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে। সেটা ১৯১৮ সালের কথা। তার আগে ‘হরতাল’ শব্দটি প্রচলিত ছিল না। হরতাল ডাকায় এবং তা পালনের প্রস্তুতি নেওয়ায় গান্ধীজি, মওলানা আজাদ সোবহানি, ডা. সাইফুদ্দিন কিচলুসহ বহু নেতার ওপর সেদিন সরকারি নির্যাতন নেমে এসেছিল। যেমন ২৭ জুন হয়েছে মির্জা আব্বাস, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি প্রমুখ নেতার ওপর।


৯২ বছর যাবৎ আমাদের দেশে হরতাল হচ্ছে। গত শতাব্দীর বিশের দশকে হরতালের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী, তাঁর একমাত্র ছেলে চিররঞ্জন দাশসহ অসংখ্য পিকেটার গ্রেপ্তার হয়েছেন। কবি নজরুল ইসলামকেও আটক করা হয়েছে। তাঁদের হাড্ডি ভাঙা হয়নি।
পাকিস্তানি ২৪ বছরে সবচেয়ে বেশি হরতাল ডেকেছেন মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু। আমরা তাতে অংশ নিয়েছি। জীবনে একবারই মাত্র মোনায়েমি পুলিশের পরশ পেয়েছি। হরতাল-মিছিলে পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধেই। সংঘর্ষ বাধুক আর না বাধুক, পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক শ্যালক-ভগ্নিপতির নয়। অর্থাৎ মধুর নয়।
সেই পাকিস্তানি আমলে আমাদের নেত্রী মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে পুলিশের ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়েছে। এরশাদ শাহীতেও তিনি, সাহারা খাতুনসহ আরও বহু নারীনেত্রী পুলিশের নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। বেগম জিয়ার দুই জামানায় সাহারা খাতুনের সঙ্গে পুলিশের আচরণ ছিল নিন্দনীয়। সে সম্পর্কে আমি বীর উত্তম কাজী নূরুজ্জামানের নয়া পদধ্বনি, কাজী শাহেদ আহমদের খবরের কাগজ ও আজকের কাগজ এবং মতিউর রহমানের ভোরের কাগজ-এ আমার কলামে প্রতিবাদ করেছি। সৌভাগ্য কাকে বলে—আজ মতিয়া আপা শুধু নন, সাহারা খাতুনও মন্ত্রী এবং পুলিশেরই মন্ত্রী। পুলিশ এখন যা করবে তার দায়দায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হবে।
হরতালের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে মহানগর পুলিশ কমিশনারের গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে তিনি আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা। হরতালের দিন টিভি সংবাদ দেখে মনে হলো তিনি জেনারেল ডায়ারের ভূমিকা পালন করছেন। ৯২ বছর আগে জেনারেল ডায়ার জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছিলেন। আমাদের পুলিশকর্তা অবশ্য সে ধরনের হুকুম দেননি। তিনি বলেছেন পেটাতে। শুধু পুরুষকে নয়, নারীকেও বেদম পেটাতে। পুরুষ পিকেটাররা তো পেটানি খাবেই, এবার পেটানো হয়েছে নারীদের। নির্মম পেটানি। বীভৎস লাঠিপেটা। মেয়েদের পিঠ-পাঁজর-কোমর ও হাত-পায়ের হাড় গুঁড়ো করা হয়েছে। এক মহিলাকে দেখলাম, তিনি পুলিশের হাতে-পায়ে ধরছেন, তবু তিনি মাফ পাননি।
আমরা মনে করছি এটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একটি নির্বাচিত সংসদ ও সরকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখছি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের চেয়ে বেশি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দিল্লির পুলিশ কমিশনার গত ৬২ বছরে মিডিয়ায় যত বক্তব্য দিয়েছেন, আমাদের ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার গত ৬২ সপ্তাহে তার চেয়ে বেশি বক্তব্য দিয়েছেন। এবং সেই বক্তব্যে শাসকের সুর। ধমকের ভাব। পুলিশ কর্মকর্তাকে দোষ দেব না। সরকারের আশীর্বাদ নিয়ে অথবা সরকারের আশীর্বাদ পেতেই তিনি বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে ধারণা করি, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, মোরারজি দেশাই, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং এসব অফিসারি তোষামতি রাজনীতি অনুমোদন করতেন না। গণতন্ত্রে সেটা করা হয় না। ভারতে হয় না, ব্রিটেনে হয় না, ফরাসি দেশেও হয় না।
স্বামীরা স্ত্রীদের পেটাচ্ছে ঘরের মধ্যে। বখাটেরা বদামি করছে রাস্তার মধ্যে বা আম-জামগাছের আড়াল থেকে। পুলিশ মেয়েদের গায়ে লাঠি দিয়ে পেটায় রাস্তার মধ্যে। হাজার হাজার মানুষের সামনে। ১২ বছর আগে যেদিন পুলিশ এক নারীর ওপর হামলা করে এবং তার কাপড় খোলে, আমি তার পরদিন সংবাদ-এ প্রথম-পাতা মন্তব্যে ঘৃণা প্রকাশ করেছিলাম। এখন আর কোনো কিছুতেই ঘৃণা হয় না। হরতালের দিন টিভিতে মহিলাদেরকে নির্মম মারধর দেখে আমার বারবার শুধু মনে হচ্ছিল: এই পুলিশরা কি ভুলে গেছেন যে তারা কোনো-না-কোনো নারীর গর্ভেই জন্মেছেন। হরতাল-সমর্থক মেয়েরা বিএনপির লোক কি না, সেটা বিবেচ্য নয়। নারী নারীই। আওয়ামীপন্থী হোক বা বিএনপিপন্থীই হোক—নিজের কন্যা হোক বা অন্যের মেয়ে হোক, খালা-ফুফু, নানি-দাদি হোক—সবাই যে আমাদের মা। এ বোধ থাকা দরকার।
হরতাল সফল হওয়ায় বিএনপির নেতারা জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। জনগণ হরতাল সফল করেনি। হরতাল সফল করেছে সরকার। কারও যদি ধন্যবাদ প্রাপ্য হয়, তাহলে তা প্রাপ্য সরকারের। বেগম জিয়া হরতালের ঘোষণা দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর থেকে হাহাকার শুরু হয়—হরতাল দিচ্ছে, সব গেল, কলকারখানা গেল, অর্থনীতি গেল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার গেল এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনাও নস্যাৎ হয়ে গেল। শুধু নেতারা নন, সরকারপ্রিয় উপসম্পাদকীয় লেখকেরা দুই হাতে লিখেছেন হরতালের বিরুদ্ধে। নেতাদের বক্তৃতা ও কলাম লেখকদের রচনায় ফল হয়েছে এই যে, জনগণ মনে করেছে, হরতাল তো আমরা কোনো দিন দেখিনি। হরতাল জিনিসটি যখন এতই খারাপ, সুতরাং তা না হয় একটি দিন পালন করেই দেখি। সুতরাং হরতাল সফল হয়ে গেল।
যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের উচিত একটু আক্কেল করে কাজ করা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.