নারী নির্যাতন-রুমানা, আমাদের ক্ষমা করুন

রুমানার এই অপ্রত্যাশিত অন্ধত্বের জন্য আমরা কিংবা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা দায়ী নয় কি? আর কত রুমানাকে এমন নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হবে? রুমানা, আপনার এই করুণ পরিণতির জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুর স্বামী হাসান সাইদ কর্তৃক নির্মম,


নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দুর্বিষহ ও অনিশ্চিত জীবন অতিবাহিত করছেন। যে মানুষটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে জ্ঞানের আলো বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নবদৃষ্টি আনয়নে ব্রতী হয়েছিলেন, আজ তিনিই দৃষ্টিহীন, যা মেনে নেওয়া সত্যিই কষ্টকর ও অবিশ্বাস্য। হাসান সাইদ শুধু একজন রুমানার চোখ উপড়ে ফেলেননি, তিনি সমগ্র বাংলার নারীদের চোখ উপড়ে ফেলেছেন। তিনি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, নারীরা নিজেদের যতই স্বাধীন হিসেবে বিবেচনা করুক না কেন আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোনো নারীই সত্যিকার অর্থে স্বাধীন নয়। নারীরা আজও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। পুরুষরা চাইলেই তাদের অর্ধাঙ্গিনীকে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো শাসন করতে পারে, ধর্মের দোহাই দিয়ে দোররা মারতে পারে এবং ফতোয়াবাজির বুলি আওড়িয়ে ঘরছাড়া করতে পারে।
আমাদের সমাজে নারীরা যে কত অসহায় তা রুমানাকে দিয়েই সহজে অনুমান করা যায়। রুমানার মতো একজন উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য যখন এমনভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হন, তখন আমাদের সমাজের নিত্যদিনের নারী নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্রটি স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। এমন অনেক রুমানার খবর হয়তো আমরা জানি না বা জানতেও পারি না। বাস্তবিক অর্থে সেই আদিম যুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি নারীরা পুরুষের ভোগ-বিলাসের পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে নারীরা আজও অর্থনৈতিক মুক্তি কিংবা রাজনৈতিক স্বাধীনতা কোনোটিই অর্জন করতে পারেনি। নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষের হাতের খেলনা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে।
নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শারীরিক নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানি এবং মৌখিক হয়রানিসহ নানাভাবে নারীরা নির্যাতিত হয়ে আসছে। আমরা এসবের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। কখনও পেশিশক্তি, আবার কখনও রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনের ফাঁকফোকরে দুর্বৃত্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধান করতে না পারায় নারী নির্যাতনের মাত্রা উল্লেখযাগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভবপর হচ্ছে না। নারীর সমান অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, যুগোপযোগী নারীনীতি বাস্তবায়নে দশকব্যাপী আন্দোলন, সিডও সনদে স্বাক্ষর প্রদান, নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতাবিষয়ক সেমিনার এবং উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের দাবিতে মিছিলসহ নানা কর্মকাণ্ডের পরও নারীর প্রতি এমন অমানবিক আচরণ কি জাতি হিসেবে আমাদের পশ্চাৎপদতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে না? নারীর প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরণ এবং অমানবিক নির্যাতন প্রতিরোধের আদৌ কোনো উপায় কি আমরা বের করতে পারি না? রুমানার ওপর এমন বর্বর ও মধ্যযুগীয় নির্যাতন দেখে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, আমাদের দেশের সরকার ও বিরোধীদলীয় প্রধান, সংসদ উপনেতা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও কৃষিমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীরা অধিষ্ঠিত। রুমানার ওপর এই নির্যাতন এ কথাই প্রমাণ করে যে, হাসান সাইদদের দানবীয় শক্তির কাছে নারী সমাজের অধিকার রক্ষার সব প্রচেষ্টা কতটা অর্থহীন।
আমরা মনে করি, যত দ্রুত সম্ভব হাসান সাইদের জঘন্য অপরাধের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত, যা দেখে ভবিষ্যতে কোনো পুরুষ কোনো নারীকে নির্যাতন করতে সাহস না পায়।
যে নারী মাত্র কয়েক দিন আগেও সুন্দর পৃথিবীর আলো-ছায়ায় নিজের এবং ছোট্ট মেয়ে আনুশাহ্র সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভেবেছিলেন, আজ তিনিই দুটি চোখের দৃষ্টি হারিয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। রুমানার এই অপ্রত্যাশিত অন্ধত্বের জন্য আমরা কিংবা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা দায়ী নয় কি? আর কত রুমানাকে এমন নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হবে? রুমানা, আপনার এই করুণ পরিণতির জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা প্রত্যাশা করি, আপনি অচিরেই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে সমগ্র জাতিকে আলোকিত করবেন।

আবু সাঈদ মোঃ নাজমুল হায়দার ও মোঃ মাহ্বুব আলম প্রদীপ : শিক্ষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.