বাজেটে সৃজনশীল বইয়ের জন্য বরাদ্দ চাই

দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সরকারের কাছে বাজেট-পূর্ববর্তী বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করে থাকেন। পোশাক শিল্প-গার্মেন্ট শিল্প, চামড়া শিল্প, ইলেকট্রনিক্স, হস্তশিল্প, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যসহ সব রকম ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে নিজেদের শিল্পকে আরও বিকাশমান করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।


সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্নভাবে তাদের বাণিজ্যিক সহযোগিতা দেওয়া হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি বাজেটেই দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টর সরকারের দৃষ্টিগোচর হলেও অবহেলায় দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে যায় আমাদের সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প।
অথচ কোনো বিষয়টি নেই প্রকাশনায়? রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, ইতিহাস, ভূগোল, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, আইন, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, বিজ্ঞান ঘুরে-ফিরে বিষয় হিসেবে এসেছে এ প্রকাশনায়। জ্ঞানভিত্তিক কিংবা মেধাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাই বইয়ের বিকল্প খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমান সরকারের 'ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টি' বাস্তবায়ন, কিংবা 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রধান সহায়ক শক্তি হলো দেশে একটি মেধাভিত্তিক প্রজন্ম গড়ে তোলা। আর এ মেধাভিত্তিক প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপই হলো পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা। সমাজে রিডিং সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করা।
এ সরকারের বর্তমান আমলে গত তিন বছরে সংস্কৃতি খাতের অর্থ বরাদ্দ আমাদের যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে। আমরা একই সঙ্গে উৎসাহিত এ সরকার দেশে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক ও মেধাভিত্তিক প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট আগ্রহী। সমাজের প্রতিটি স্তরে রিডিং সোসাইটি গঠনে এ উদ্যোগ সফল হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু রিডিং সোসাইটি গড়ে তোলার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হলো প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বইটি পাঠকের হাতের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। আর এ জন্য প্রয়োজন দেশের প্রকাশনা শিল্পকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান।
অথচ বলতে গেলে সরকারের কোনো রকমের সহযোগিতা ছাড়াই চলছে দেশের সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও এখানে গড়ে ওঠেনি সৃজনশীল বইয়ের একটি মার্কেট। বই প্রকাশনার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজের দামও আকাশচুম্বী। তাই খুবই স্বাভাবিক নিয়মে বইয়ের দামও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আর এ কারণে প্রয়োজনীয় অনেক বই আমাদের পাঠকের ক্রয়সীমার বাইরে থেকে যায়। অথচ সৃজনশীল প্রকাশনার জন্য
শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির ব্যবস্থা করলে বইয়ের দাম অনেক কমে যাবে বলে
আমাদের বিশ্বাস।
প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে ভালো পাণ্ডুলিপি ছাপতে পারেন না অনেক প্রকাশক। ব্যাংকগুলোও এ দেশের প্রকাশনা শিল্পকে কোনো রকমের সহযোগিতা করতে চান না। এ দুর্যোগ থেকে প্রকাশনা শিল্পকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন সৃজনশীল প্রকাশনাকে সরকারের পক্ষ থেকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা। এখানে উলেল্গখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত দেশের লাখ লাখ মানুষ। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় সারাদেশের মানুষ যেভাবে একাত্ম হয়ে পড়ে তাতে করে এ মেলা একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়ে যায়। পুরো জাতিকে এই এক মাস লেখক-প্রকাশকরা একসূত্রে গ্রথিত করেন তাদের সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ দিয়ে। পুরো বিশ্ববাসীর সামনে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর এত বড় আবেগময় আর সৌহার্দ্যপূর্ণ মিলনমেলা বোধকরি আর দ্বিতীয়টি নেই। এই অর্জন দেশের প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সব কর্মীর। অথচ এ একটি মাস ছাড়া বছরের বাকি এগারোটি মাস প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো নিমজ্জিত থাকে অন্ধকারের চোরাগলিতে। বছরের বিভিন্ন সময়ে অনিয়মিত কিছু বইমেলা করে স্বল্পবিস্তর পাঠকের কাছে বইকে নিয়ে গেলেও দেশের অধিকাংশ পাঠকই বঞ্চিত হন বই পড়া থেকে।
আমরা জানি, একটি দেশের সংস্কৃতি ধ্বংস করার প্রয়োজন হলে সেই দেশের জনগণের বই পড়াকে বন্ধ করলেই যথেষ্ট। কিন্তু বর্তমান সরকার সংস্কৃতিবান্ধব সরকার। আমরা একই সঙ্গে বলতে পারি, বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ অন্য অনেক মন্ত্রীই সরাসরি লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এ সরকারের কাছে আমাদের দাবি, দেশের আগামী অর্থবছরের বাজেটে সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।
একটি ভালো বই হলো পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানের জানালা। মনীষীদের ভাষায়, একটি বন্ধ ঘরে ঢুকেই আমরা ঘরের জানালা খুলে দেই আলো-বাতাস এসে যাতে ঘরের গুমোট আবহাওয়াকে মুক্ত আবহাওয়ায় পরিণত করতে পারে। ঠিক তেমনই একটি বই আমাদের মস্তিষ্কে আলো-বাতাস নিয়ে আসে। এই আলো জ্ঞানের আলো। বই তাই আমাদের কাছে পৃথিবীকে জানার জানালা। বর্তমান সরকারের ভিশন পূরণের নিমিত্তে আমাদের সমাজের বন্ধ জানালাগুলো উন্মোচনের জন্য তাই আমাদের প্রত্যাশা মানুষের মেধা ও জ্ঞানের জানালা উন্মোচন করার ব্যবস্থা করা।

লেখকরা সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থার
প্রকাশক ও লেখক

No comments

Powered by Blogger.