শুল্ক প্রস্তাব-দেশীয় মুদ্রণশিল্প কতটা সুফল পাবে? by আ ফ ম শাহ আলম

বাংলাদেশের মুদ্রণ দর অন্য সব দেশের তুলনায় কম থাকা সত্ত্বেও মুদ্রণ কাঁচামাল (কাগজ, কালি ও কেমিক্যাল) আমদানির ক্ষেত্রে মোট ৬১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। অন্যদিকে বিদেশিরা সম্পূর্ণ শূন্য শুল্কে কাঁচামালপ্রাপ্ত হয় বিধায় বিদেশি পুস্তক রফতানিকারকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক দরপত্রে এ দেশের মুদ্রণকারীরা এক অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।


এ ক্ষেত্রে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেওয়ার মতো অবস্থা বিরাজমান



২০১১-১২ অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ঘোষণায় ১২ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক আমদানির ক্ষেত্রে এখনই আরোপের জটিলতায় এ দেশের মুদ্রণশিল্প রক্ষায় কতটুকু বাস্তব সুফল পাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পাঠ্যপুস্তক আমদানির একমাত্র সরকারি সংস্থা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সরকার ঘোষিত এ শুল্ক সুবিধা দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে না দেওয়ার ফন্দিফিকিরে ব্যস্ত রয়েছে। বিদেশি দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাখিল করা মোট দরের সঙ্গে এনসিটিবি কর্তৃক ব্যয়িত সব খরচ যোগ করে দরপত্র মূল্যায়নের স্থলে শুধু উদৃব্দত দরকে মোট দর ধরে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্ধারণ করায় দেশীয় মুদ্রণশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১২ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরের আন্তর্জাতিক দরপত্রে কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এনসিটিবি এ দেশের মুদ্রণকাজকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত আছে বলে মনে হচ্ছে। মুদ্রণকাজ মুদ্রণকারী ছাড়া করার বিধান বাংলাদেশ আইনে না থাকা সত্ত্বেও বিদেশিদের ক্ষেত্রে সরবরাহকারীর এ দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে দেশীয় প্রতিষ্ঠান পাঁচটি লটের অধিক দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারবে না_ এ শর্ত থাকলেও প্রাথমিক স্তরের বিদেশিদের ক্ষেত্রে সব লট একটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ রেখে দেশের কাজ বিদেশে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত রয়েছে এনসিটিবি এবং ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান সব মুদ্রণকাজের জন্য অংশগ্রহণ করে নজির সৃষ্টি করেছে। সরকারের সব প্রচেষ্টা দেশীয় মুদ্রণশিল্প রক্ষার জন্য করা হলেও এনসিটিবির বর্তমান চেয়ারম্যান ও কিছু কর্মকর্তা বিদেশিদের সঙ্গে মহাআঁতাতে ব্যস্ত থেকে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এ মুদ্রণকাজ বিদেশে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।
দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে এনসিটিবির এসব কর্মকর্তা অবৈধ সুযোগ গ্রহণে খুব বেশি সুবিধা পান না বিধায় বিদেশিদের সঙ্গে একক ও বড় ধরনের সুবিধা নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দেশের সাত হাজারের অধিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে এবং দুই লক্ষাধিক কর্মজীবী ও হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় স্থাপিত এ শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুদ্রাকরদের দাবির ফলে দেশে তৈরি পাঠ্যপুস্তকে সব পাণ্ডুলিপি দেশে মুদ্রণ করার জন্য সরকার ঘোষিত বাজেটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক আমদানির ওপর ১২ শতাংশ শুল্ক ধার্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পুস্তক আমদানিকারক হিসেবে এনসিটিবি এ শুল্কসহ অন্যান্য খরচ বিদেশি দরদাতাদের দরের সঙ্গে যোগ করে মূল্যায়ন না করায় দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো দর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।
বাংলাদেশের মুদ্রণ দর অন্য সব দেশের তুলনায় কম থাকা সত্ত্বেও মুদ্রণ কাঁচামাল (কাগজ, কালি ও কেমিক্যাল) আমদানির ক্ষেত্রে মোট ৬১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। অন্যদিকে বিদেশিরা সম্পূর্ণ শূন্য শুল্কে কাঁচামালপ্রাপ্ত হয় বিধায় বিদেশি পুস্তক রফতানিকারকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক দরপত্রে এ দেশের মুদ্রণকারীরা এক অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেওয়ার মতো অবস্থা বিরাজমান। সরকারের সব নীতিনির্ধারণী মহলে এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সামান্য হলেও ১২ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণের প্রস্তাবটিও এনসিটিবি কর্তৃক বাস্তবায়ন না করার সব পাঁয়তারা পরিলক্ষিত হওয়ায় সরকারের মধ্যে এনসিটিবি আরেকটি সরকার বলে প্রমাণ করছে।
দেশের শিল্প বিকাশের স্বার্থে এবং বিপুল জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারের অনেক কর্মসূচির কথা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী প্রতিনিয়ত বললেও সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ দেশের মুদ্রণশিল্প রক্ষার ক্ষেত্রে এনসিটিবির বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত ও নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের নীরব ভূমিকায় বিরূপ ধারণা দেখা দিয়েছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে। শিক্ষামন্ত্রীর বিপুল সুনাম থাকলেও তার নিয়ন্ত্রণাধীন এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ক্ষেত্রে এ ধরনের দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে অনেকের কাছে।
এ দেশের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের এই বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রেরণ করে আসছে। চলতি শিক্ষাবর্ষেও প্রায় ২৩ কোটি পাঠ্যপুস্তক এ দেশের মুদ্রণকারীরা যথাসময়ে মুদ্রণ করে সরবরাহ করেছে ডিসেম্বর ২০১০-এর মধ্যে। এ বছরও একটু আগে কার্যাদেশ দিলে এবং মুদ্রণ কাগজ ও পজিটিভ এনসিটিবি যথাসময়ে সরবরাহ করলে এ দেশের মুদ্রাকররা ডিসেম্বর ২০১১-এর মধ্যে ২০১২ শিক্ষাবর্ষের সব বই সরবরাহ করতে বদ্ধপরিকর।
বর্তমানে দেশীয় মুদ্রণশিল্পের অগ্রগতি এ শিল্পকে রফতানিমুখী শিল্পে পরিণত করেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে দেশের মুদ্রণকাজ দেশীয় পাণ্ডুলিপিতে তৈরি পাঠ্যপুস্তক এক অসম শুল্কবৈষম্য তৈরি করে বিদেশে পাঠানোর সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে এনসিটিবি দেশীয় শিল্পকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে।
এমনই প্রেক্ষাপটে দেশের সর্বোচ্চ মহল কৃপাদৃষ্টি না দিলে বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্তত এবার সরকার ঘোষিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক আমদানির ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ শুল্ক প্রস্তাব এখনই বাস্তবায়ন করে এনসিটিবি কর্তৃক আহূত আন্তর্জাতিক দরপত্রের ক্ষেত্রে সংযোজন করা হলে এ শিল্প ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

আ ফ ম শাহ আলম : সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতি
 

No comments

Powered by Blogger.