উন্নয়ন-দারিদ্র্যই আমাদের পুঁজি by এম আবদুল হাফিজ

চার দশক আগে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল বিশ্বের এক হতদরিদ্র দেশ হিসেবে। এতটাই দরিদ্র যে, এ দেশের টিকে থাকার সম্ভাবনা সম্পর্কেও সন্দিহান ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এ দেশের দারিদ্র্যকে নিয়ে একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিল দাতাগোষ্ঠীর মুরবি্বরা।


তখনকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী আফ্রিকার আপার ভোল্টা নামক দেশটাই শুধু বাংলাদেশের চেয়ে অধিক দরিদ্র ছিল। বাংলাদেশ তবু টিকে আছে, যদিও দীর্ঘ ৪০ বছর পর দারিদ্র্য আজও নির্মমভাবে জর্জরিত করে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে বিশ্বের অন্যতম স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিল। আজও এ দেশ বিশ্বের ডজনতিনেক স্বল্পোন্নত দেশের অন্যতম। তার অর্থ এই যে, উন্নয়নে আমাদের এক ইঞ্চি অগ্রগতিও হয়নি।
অবশ্য দেশের কর্তাব্যক্তিরা যে এই আপদ সম্পর্কে বিস্মৃত, এমন কথাও বলা যাবে না এবং তারা তো দারিদ্র্যকে নির্মূল করার লক্ষ্যে প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতি উচ্চারণে সতত উচ্চকণ্ঠ। দেশের অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা নিষ্ঠার সঙ্গে দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি ও গভীরতা পরিমাপ করতে ব্যস্ত। বিষয়টিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন বিপুলসংখ্যক গবেষক ও পণ্ডিত ব্যক্তি। বিভিন্ন সরকার, তাদের পরিকল্পক এবং সাহায্যদাতারাও কম বিব্রত হয়নি জনজীবনের এই অভিশাপ নিয়ে। দারিদ্র্য প্রতিরোধ করার তৎপরতা অব্যাহত আছে তাদের পক্ষ থেকেও।
তবু কিন্তু দারিদ্র্য এ দেশে জেঁকেই বসে আছে অদ্যাবধি। দারিদ্র্য বিমোচনের এন্তার পদক্ষেপের কোনো ইতিবাচক ফল হয়েছে, তার প্রমাণ নেই। একটিই ফল, যা দৃষ্টিগোচর হয়_ তা হলো বাংলাদেশ আজ দারিদ্র্যের গভীর থেকে গভীরতর গহ্বরে নিপতিত এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি দেশবাসী আজ দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনধারণ করছে। এ অধোগতির কোনো বিহিত হয়নি; হবে যে তারও লক্ষণ নেই। গত চার যুগে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতিকল্পে এ দেশে লক্ষ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান এসেছে। কিন্তু যাদের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে এই বিপুল অঙ্কের সাহায্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে, সেসব দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যে জুটেছে এ বিপুল পরিমাণ অর্থের মাত্র ২৫ শতাংশ। যদিওবা তার কতটুকুর ফলপ্রদ ব্যবহার হয়েছে তাদের স্বার্থে, সে সম্বন্ধেও ব্যাপক সন্দেহের অবকাশ আছে। বাদবাকি টাকা লুটে নিয়েছে বিদেশি পরামর্শদাতা, দেশজ কমিশন এজেন্ট এবং পরামর্শক আমলা, রাজনীতিবিদ, ঠিকাদাররা।
এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, দারিদ্র্য বিমোচনের হাজার হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ঋণ স্ফীতির একটি সংগঠিত পথ সৃষ্টি হয়ে দেশে একটি বিপুল বৈষম্যের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, যা সমাজের বৃহৎ অংশে দারিদ্র্যকে উত্তরোত্তর ঘনীভূতই করতে থাকবে। দারিদ্র্যের যারা প্রত্যক্ষ শিকার তাদের অভিজ্ঞতা যতই তিক্ত হোক না কেন, অনেকের জন্য দারিদ্র্য আবার সৌভাগ্যের চাবিকাঠি, যদি তারা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এর ব্যবহার করতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের নেতাদের জন্য এটি একটি বিরল সম্পদ, যার দোহাই দিয়ে এরা মোটাদাগের সাহায্য ও অনুদানের জন্য কেস (পধংব) ফাঁদতে পারে এবং তার সপক্ষে ওকালতি করতে পারে। তারা জানেন, যত বেশি সাহায্য পাওয়া যাবে সেই অনুপাতে তারা এবং তাদের সাঙ্গাতরা বখরার ভাগীদার হবেন।
যেসব দেশে দারিদ্র্যের সমস্যা যত জটিল এবং যারা সাহায্যের জন্য যত বেশি মরিয়া হয়ে ওঠে, তাদের ওপরই সাহায্যদাতারা তত বেশি কড়া শর্তারোপ করে থাকে। অবশ্য এতে সাহায্যপ্রাপ্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সনাতনী পোষ্য-পৃষ্ঠপোষক (পষরবহঃ-ঢ়ধঃৎড়হ) সম্পর্ক বহাল থাকে, যা সাহায্যদাতা ও সাহায্যপ্রাপ্ত উভয়েরই স্বার্থের অনুকূলে। দারিদ্র্য এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যা একাডেমিকদের দেয় প্রাণবন্ত আলোচনার জন্য আনকোরা বষয়বস্তু এবং গবেষকদের জন্য সন্দর্ভ রচনায় চিন্তার খোরাক। পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এরই মধ্যে এ দেশের বহু প্রতিভাবান শিক্ষার্থী দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর কাজ করে ডিগ্রি হাসিল করেছে।
দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও ব্যাধির দোহাই দিয়ে হাজার হাজার এনজিও গজিয়ে উঠেছে দেশের অভ্যন্তরে। এগুলোর প্রচেষ্টায় কসমেটিক দারিদ্র্য বিমোচন হয়ে থাকলেও এনজিও সংগঠকরা আজ আভিজাত্য ও এলিটিজমের নতুন উত্তরাধিকারী। বিষয়টির বিশ্লেষণ উপলক্ষে আমাদের এলিট শ্রেণীর জন্য ঘন ঘন একত্র হওয়ার সুযোগ আসে নগরীর অভিজাত হোটেলগুলোতে। দারিদ্র্য একটি পণ্য, যে কেউ যে কোনো মূল্যে একে বিকোবার চেষ্টা করে। দারিদ্র্যের জটিল আলোচনা ও বিশ্লেষণ আমাদের এলিটদের দেয় দুর্লভ খ্যাতি এবং 'বিশিষ্টজন'সুলভ চমক। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির সুদৃশ্য ভবনে কর্মকর্তারা আমাদের দারিদ্র্যের অঙ্ক কষেন এবং তাদের তথ্যসমৃদ্ধ পরিসংখ্যান রচনা করেন।
আমাদের দেশে জাতীয় ইস্যু নিয়ে খোলামেলা বিতর্ক কালেভদ্রে হয়ে থাকে। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয় নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট প্রচলন আছে এ দেশে। দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মশালা ও গোলটেবিল আলোচনা এন্তার হয়ে থাকে। আশ্চর্য হলেও এসব আলোচনা ও অংশগ্রহণও ব্যাপক। মজার ব্যাপার যে, এসব সভায় তারাই বেশি অংশগ্রহণ করে, দারিদ্র্য যাদের একেবারেই স্পর্শ করে না। তাই দারিদ্র্য সম্পর্কে এসব অংশগ্রহণকারীর অভিজ্ঞতাও অধিবাস্তব। এ ছাড়া যে পরিমণ্ডলে আমাদের দেশে দারিদ্র্যের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে দারিদ্র্যের আবহ একেবারেই অনুপস্থিত। দরিদ্র অর্থাৎ যাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার আয়োজন, তাদেরও ত্রিসীমানায় সেখানে স্থান নেই।
অবস্থাদৃষ্টে এ কথাই মনে হবে যে, তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা যাতে এটি নিরুপদ্রব পরিবেশে উর্বর চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারেন, তারই জন্য এমন ব্যবস্থা। তবু তাদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণা বা তত্ত্বগুলো বাস্তবতাবিবর্জিত। শুধু পুরনো কথারই অসংলগ্ন পুনরাবৃত্তিই নয়, তা বাস্তবতাবিবর্জিতও। দারিদ্র্যের ওপর হাজারো বিতর্ক ও আলোচনান্তে সুপারিশমালার একপ্রান্তে আছে নিছক 'ইউটোপিয়া' এবং অন্যপ্রান্তে বাগাড়ম্বরসর্বস্ব শব্দ সমষ্টি। তবু বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন পটভূমির লোকজন আসে এবং দারিদ্র্যের আলোচনায় অংশ নেয়।
রাজনীতিকরা অংশ নেন, কারণ তারা প্রচার লাভ করেন। তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ফলাও করে প্রকাশ করা হয় সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায়। বুদ্ধিজীবীরা যে কোনো রকম ফোরামের সন্ধানে থাকেন, যেখানে তারা তাদের বাগ্মিতা নৈপুণ্যকে শাণিত করতে পারবেন। বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তা সে দারিদ্র্য বিমোচনই হোক বা চৈনিক দর্শনই হোক। বাতিকগ্রস্ত পাঁচমিশালি পণ্ডিতদের জন্য সুশীল অনুগত শ্রোতাই যথেষ্ট, যারা মুগ্ধ তন্ময়তায় শুনবে তাদের দারিদ্র্যের জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ। যে কোনো বিতর্ক সভায় নগরীর প্রবীণ ভদ্রকুল একটি সামাজিক সমাবেশের স্থান খুঁজে পায়। দারিদ্র্যের আলোচনায় আরও যোগ দেন সাবেক মন্ত্রী ও আমলা, যারা অতীতের অনেক অনিয়ম ও ব্যর্থতার জন্য দায়ী। অনেকের বিস্মৃতির সুযোগ নিয়ে তারাও সাফাই গান তাদের অপকীর্তির।
দুঃখজনক হলেও 'দারিদ্র্য বিমোচনের' মতো মহতী আলোচনাও ক্ষণিকের উৎসবের আমেজের মধ্য দিয়েই শেষ হয়। এমনকি এর ইতিবাচক সুপারিশগুলো কদাচিৎ কোনো পরিণতি পর্যন্ত পেঁৗছানো হয়। দারিদ্র্য সংক্রান্ত কোনো গোলটেবিলে আলোচিত চুম্বক বিষয়গুলো অবশ্য কিছুদিন বিদগ্ধ মহলে গুঞ্জরিত হতে থাকলেও একসময় তাও গতানুগতিকতার ধারায় স্তব্ধ হয়ে যায়। তবে সমস্যার সুন্দর সুন্দর বিশ্লেষণ ও সংকট উত্তরণের দিকনির্দেশনা সংবলিত সুপারিশমালা শেষ পর্যন্ত রয়ে যায় তাদের সুদৃশ্য মোড়কে এবং দারিদ্র্য বিরাজ করে তার নিজস্ব জায়গায়।
আমাদের দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় সমস্যাই হলো, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ক্রেডিবিলিটির অভাব। এরা কদাচিৎ দারিদ্র্য বিমোচনে আগ্রহী, না তারা এ লক্ষ্য অর্জনে নূ্যনতম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কমিটমেন্টের এটি একটি সামান্য পরীক্ষা যে, তারা এ লক্ষ্যে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা হ্রাসেও প্রস্তুত থাকবে। আমরা সবাই দারিদ্র্যের অবসান চাই। কিন্তু মুহূর্তেই পিছপা হই যখন দেখি যে, তাতে আমাদের সুবিধা ও আরাম-আয়েশ খর্ব হয়। তখনই আমরা স্ট্যাটাসকোর পথ খুঁজি। আমরা সর্বদা বৈষ্যমহীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মতো উদার কথাবার্তা উচ্চারণ করি। কিন্তু আত্মসংরক্ষণের গহ্বরে প্রবেশ করি, যখন আমাদের সচ্ছলতাকে বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগির প্রশ্ন ওঠে। কী নিদারুণ ভণ্ডামি!
সমাজের শীর্ষে যাদের অবস্থান, দারিদ্র্যসহ একাধিক দুরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া তাদের জন্য এক ধরনের বিলাসিতা। দারিদ্র্যের জন্য রোমান্স আমাদের নতুন কিছু নয়। বাম রাজনীতির উত্তাল দিনগুলোতে এই নেশা অনেক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের পেয়ে বসেছিল। সেই নেশায় বুঁদ হয়ে একসময়ে জমিদার নন্দনরা প্রজা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিত। দারিদ্র্য এবং তৎসংশ্লিষ্ট সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। দারিদ্র্যকে প্রতিরোধ করতে হবে সব ফ্রন্টে এবং তা একই সময়ে। গোঁজামিল, উদ্যমহীন প্রচেষ্টা ও খণ্ডিত কর্মসূচি দিয়ে আর যা-ই হোক, দারিদ্র্য বিমোচন হয় না। অথচ দীর্ঘদিন ধরে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে তা-ই হয়ে এসেছে। এ দেশে যদিও এ লক্ষ্যে সম্পদের অভাব কখনও ছিল না। যে ভাগ্যবানরা দারিদ্র্যের বেষ্টনীর বাইরে আছেন, তাদেরও আত্মতুষ্টির কারণ নেই। কারণ দারিদ্র্য যেখানেই যতটুকু অবশিষ্ট থাক না কেন, তা নিশ্চিতভাবে সর্বত্রই উন্নতি বা উন্নয়নের জন্য হুমকি।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক, বিআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.