প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী-আওয়ামী লীগকে এখন সামনে চোখ রাখতে হবে by ওবায়দুল কাদের

অবিশ্বাস-সন্দেহের দেয়াল ভেঙে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, পরিবারে-সমাজে, দলাভ্যন্তরে, সরকার দল-বিরোধী দলে ব্রিজ স্থাপন করে সমন্বিতভাবে এগোতে হবে। আলোচনা বা ডায়ালগ ছাড়া কোনো সমস্যারই সমাধান হয় না। সরকার দল এবং বিরোধী দল যত দূরেই থাকবে ততই বিরোধ বাড়বে।


রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। এ রাজনীতির মাধ্যমেই দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যবদল করতে হবে। রাজনীতিকে বদলাতে হবে, রাজনীতিবিদদের বদলাতে হবে। মানুষের কথা চিন্তা করে আমাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিতে হবে। ২০২১ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে কার্যকর করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যবদল, আমাদের মন্ত্রী-এপিদের ভাগ্যবদল নয়



ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রাথমিক পর্বে, ব্রিটিশের ধামাধরা থেকে স্বজাতির কিছু অধিকার আদায়ের চেষ্টা থেকে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। পরবর্তী সময়ে নানা ধারা-উপধারায় গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, অহিংস দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতার চেতনায় সমৃদ্ধ নেতৃত্বে এমনকি কখনও চরমপন্থি, শোভিনিস্ট, ফ্যানাটিক ধারার নেতৃত্বে আচ্ছন্ন হয়ে এই দুটি দলই ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি দেশের জন্মের রূপকার ও স্রষ্টা। দ্বিজাতিতত্ত্বে সৃষ্ট এ দুটি দেশের জন্ম এতটাই ট্র্যাজিক যে, এখানে বহু মানুষ ইংরেজমুক্ত অর্থে স্বাধীনতা পেয়ে, মাতৃভূমি হারালো, বিতাড়িত হলো। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় দিশেহারা হয়ে ডাইরেক্ট অ্যাকশনের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেশ খুঁজে বেছে নিতে কষ্ট হলো। জন্মভূমি মেদেনীপুর ভারত না মুসলিম পরিচয়ের পাকিস্তান?
কালের আয়নায় এসব দৃশ্য অবলোকনে আজও ছোটগল্প পাঠের চিনচিনে ব্যথা অনুভব করি। নারায়ণগঞ্জের জ্যোতি বসু স্বাধীনতা সংগ্রামী হয়েও দেশ হারালো। ভাগ্যিস সুকান্ত মারা গেছেন, তার ভাতিজা পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাপ-দাদার ভিটা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। এমনিভাবে মানিকগঞ্জের অমর্ত্য সেন, বিক্রমপুরের বুদ্ধদেব বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ফরিদপুরের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, ময়মনসিংহের উপেন্দ্র, সুকুমার, সত্যজিৎ রায়, রাজশাহীর ঋতি্বক ঘটকসহ আরও কত জ্ঞানী ও গুণী আমাদের (বাংলাদেশের) থাকলেন না। জীবনানন্দ দাশ চলে গেলেন। কাজী নজরুল ইসলাম আগেই চেতন হারিয়েছেন। তাকে এ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি (পরবর্তী সময়ে বঙ্গবল্পুব্দ বাংলাদেশের জাতীয় কবি করে তাকে সম্মানিত করে এনেছেন)। প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী হয়েও শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক মাতৃভূমি ছেড়ে এলো কিংবা আসতে হলো। সব্যসাচী লেখক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আমি মন্ত্রী থাকাকালে কিছুদিন আমার প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি কষ্ট পেতেন কি-না জানি না; কিন্তু তার কিংবা তাদের মাতৃ-পিতৃভূমির কথা মনে হলে কেমন যেন কষ্ট হয়। এমনকি জন্মসূত্রে পাকিস্তানি মনমোহন সিং এবং জন্মসূত্রে ভারতীয় পারভেজ মোশাররফের জন্য আক্ষেপ হয়। দেশ, মাতৃ-পিতৃভূমিকেন্দ্রিক এই বোধ কূপমণ্ডূকতা হলে আন্তর্জাতিকতাবাদী রবীন্দ্রনাথের_ 'যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ূক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা' বা দেশ পর্বের কোনো গানই লিখতেন না কিংবা প্রাণ হৃদয় মন্থনে মানবতারও ঊধর্ে্ব উঠে জীব-প্রাণ জগৎকে উপলব্ধিতে আনা ক্যাম্পের কবি জীবনানন্দ_ 'এসব ছেড়ে কে যাবে বিদেশে বলো, আমি কোন মতে বাসমতি ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে, উটির পর্বতে যাব নাকো' জাতীয় কবিতা তথা 'রূপসী বাংলা' লিখতেন না। মাঝে মধ্যে ভাবি ১৯৩০-এর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতা মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামী তিতুমীর, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ১৯৪৭-এর পর বেঁচে থাকলে কোন দেশ বেছে নিতেন? কোন দেশের নেতৃত্ব দিতেন? তারা কি আদৌ কখনও স্বাধীন হয়েছেন বলে ভাবতেন? এসব অনুভূতির সংমিশ্রণ ও ১৯৪৮-এর ভাষার অধিকারের টানাপড়েনে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম ধারার মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্ব জেগে ওঠে, জেগে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান।
আগেকার এ রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনের আসাম-আন্দোলনের নেতা মওলানা ভাসানী ও মুসলিম লীগের প্রগতিশীল ধারার নেতৃত্বের সমন্বয়ে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। যার সভাপতি হন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। এ আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাস্ত করে। ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে 'মুসলিম' শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে। এরপর ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জারি হওয়া আইয়ুব খানের মার্শাল ল'র বিরুদ্ধে লড়াই। ১৯৫৯ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়ে গোপনে সহকর্মীদের কাছে 'স্বাধীন বাংলা' প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। গঠন করেন নিউক্লিয়াস। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৪-এর শিক্ষা আন্দোলন, দাঙ্গা প্রতিরোধী 'বাঙালি রুখিয়া দাঁড়াও' আহ্বান ও ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে গিয়ে শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা উত্থাপন করেন। গোলটেবিল ভেঙে যায়।
১৯৬৬ সালের ১৮ ও ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ৬ দফা অনুমোদন করে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। সারা বাংলায় পরাধীন বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবের ঝটিকা সফল। গ্রেফতার, মুক্তি আবার গ্রেফতার এবং অবশেষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় দীর্ঘ কারাবরণ। প্রতিবাদে-প্রতিকারে ১৯৬৯ সালে ৬ দফাভিত্তিক ১১ দফা দাবিতে ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান। ২২ ফেব্রুয়ারি নিঃশর্তভাবে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন 'বঙ্গবল্পুব্দ'। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের 'বাংলাদেশ' নামকরণ করেন বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান। '৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভ করেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ইয়াহিয়ার সরকার মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। আওয়ামী লীগের সুনিপুণ নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্রমে যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ প্রাণ ও দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুক্ত স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ 'আমার সোনার বাংলা'র সুর-আবহে রচিত লাল-সবুজ পতাকায় আচ্ছাদিত 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্রের সাংগঠনিক রূপকার ও স্রষ্টা। বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান এ জাতি-রাষ্ট্রের পিতা।
সংগ্রাম, সাফল্য ও অর্জনের গৌরবোজ্জ্বল ৬২ বছরে এসে মনে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চিরকাল মানুষের ভাগ্যবদলের রাজনীতি করেছে। আর টার্গেট হয়েছে ষড়যন্ত্রের; কখনও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে যায়নি। ষড়যন্ত্র রুখতেই আওয়ামী লীগের শক্তি ক্ষয় হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ-কোলাহল নিরসনে ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবল্পুব্দকন্যা শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এ বছর উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও শান্তির সংগ্রামে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে তিন দশক পার করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল কংগ্রেস ১৯৪৭-এর পর ৬৪ বছর ধরে দু'তিন সেশনে ১৩ বছর বাদ দিলে প্রায় টানা ক্ষমতায়। অন্যদিকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ স্বাধীনতার চার দশকে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ সাকুল্যে ক্ষমতায় ছিল, আছে মাত্র ১১ বছর। পাকিস্তানের ২৩ বছরে যুক্তফ্রন্ট-আওয়ামী লীগ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার জান্তা সরকার ক্ষমতায় ছিল ১৬ বছর। স্বাধীনতা-পরবর্তীও প্রায় একই ধারার ষড়যন্ত্রে পিষ্ট হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারকেই আমাদের কমন বিপদ দারিদ্র্য, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও সুযোগসন্ধানীদের থেকে জাতি ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করে জনগণের ভাগ্যবদল-দিনবদলে ব্রতী হতে হবে।
আমি বলব, দলের সরকারের টিম লিডার ঠিক জায়গায়ই আছেন। এবারের প্রধানমন্ত্রী '৯৬-এর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে অভিজ্ঞ এবং শক্তিশালী। তবে '৯৬ সালে যে টিমওয়ার্ক ছিল এবার তা নেই। দল এবং সরকারে যে টিমওয়ার্ক হওয়া দরকার তা হচ্ছে না। দল, সরকার এবং মহাজোটে যে ধরনের সমন্বয় থাকা দরকার তা নেই। সে সময়ের আওয়ামী লীগ এবং সরকার আলাদা ছিল। এখন মনে হয় দল সরকারে কিছুটা হারিয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দলকে ঘিরে সরকার পরিচালিত হবে, সরকারকে ঘিরে দল পরিচালিত হবে না।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কাজে যে সময় দেন, দেশের প্রতি তার যে কমিটমেন্ট তা সরকারে আর ক'জনের মধ্যে আছে? তিনি যে মিটিং করেছেন, সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা কতটা পালন হচ্ছে, বাস্তবায়ন হচ্ছে_ এ বিষয়টি আমাদের ভাবতে হবে। এখানে যদি কোনো দুর্বলতা থাকে তাহলে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। এ কাটিয়ে ওঠাটা জরুরি। সরকারের আড়াই বছর চলে গেছে, সামনে আর আড়াই বছর আছে। এ সময়ে জনগণকে দেওয়া সরকারের প্রতিশ্রুতির ৬০ থেকে ৭০ ভাগ পূরণ করতে হবে। এ সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কাজ করতে হবে। এর একটি হলো দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। মানুষের ঘরে আলো দিতে হবে। বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের মনের ভয় দূর করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে মানুষের মনে যাতে কোনো ভয় না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ তিনটি বিষয় সহনীয় পর্যায়ে না রাখতে পারলে আগামী নির্বাচনে প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক।
এসব বিষয়ে সরকারও সচেতন আছে। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের বিষয়ে সরকার ত্বরিত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় জনগণের মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সঠিক এবং যথার্থ সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। আর এতে মনে হয় সরকারের ভুল সংশোধনের মানসিকতা আছে। আমরা মনে করি, সরকারের সামনে যেসব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ আছে তা সঠিক সময়ে সঠিক লোক দিয়ে সমাধান করতে সচেষ্ট হতে হবে। শেয়ারবাজার জনমনে কতটা ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তা খতিয়ে দেখে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
'ঐক্যবুদ্ধিতেই সমৃদ্ধি' বা 'পল্লী সঞ্জীবনেই দেশের সঞ্জীবন' রবীন্দ্রনাথের এ অমোঘ বাণী জানেন, মানেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সভানেত্রী সরকারের টিম লিডার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শহরকে দেশ মনে করেন না। তাই উত্তরবঙ্গের মঙ্গার কথা বিগত আড়াই বছরে কেউ শোনেনি। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে ও ন্যায্যমূল্যে চাল পাচ্ছে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ।
সমস্যাটা ঐক্যবুদ্ধিতে। এমন এক দুষ্টচক্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে আমরা পড়েছি, এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আদালতে অবৈধ ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে বহুবার এ বিষয়ে আলোচনার জন্য এমনকি নতুন ফর্মুলা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধী দল আলোচনায় না এসে নানা শর্ত দিচ্ছে এবং হরতাল করছে, লাগাতার হরতালের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। শর্ত দিয়ে সংলাপ হয় না। সংলাপের উত্তাপ দিয়ে সংকটের বরফ গলাতে হবে। ১৯৯৬ সালে মাগুরা নির্বাচনের পর জনগণের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপেক্ষা করে বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনে ২৭৩ আসনের ব্রুট মেজরিটি পায়। এরপর আন্দোলনের চাপের মুখে মধ্যরাতে অধিবেশন বসিয়ে এককভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে। আলোচনাবিহীন মধ্যরাতে সংঘটিত এ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হবে_ এটাই তো স্বাভাবিক। একে ত্রুটিমুক্ত করতে খোলামনে আলোচনা জরুরি, অথচ বিএনপি ঐক্যবুদ্ধির পথে হাঁটছে না।
তবু আমি বলব, জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় জাতীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। উন্নয়নের লক্ষ্যে ডাক দিতে হবে জাতীয় মহাসংগ্রামের। আমাদের সামনে অপ্রিয় অতীতের রক্তাক্ত কিছু বিষয় আছে। যেগুলো এখনও আমাদের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। এই অপ্রিয় রক্তাক্ত বিষয়গুলো আমাদের মধ্যকার অসহিষুষ্ণতার জন্ম দিচ্ছে। দূরত্ব বাড়িয়ে তুলছে। দেশের মানুষ কিন্তু রাজনীতির এমন তিক্ত পরিস্থিতি চায় না। মানুষ শান্তি চায়, স্থিতিশীলতা চায়। শান্তি এবং স্থিতিশীলতা না থাকলে উন্নয়ন ও বিনিয়োগ পরিবেশ থাকে না। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে রাজনীতিতে পরস্পরের সহাবস্থানের জায়গাটি বেছে নিতে হবে। জাতীয় ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আমাদের অভিন্ন গৌরবকে রক্ষা করতে হবে। অভিন্ন অতীত-ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া অভিন্ন বিপদ, অভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় দরকার কমন গ্রাউন্ড। প্রয়োজন একসঙ্গে কাজ করা। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের এ জায়গায় যেতে হবে। তা না হলে বারবার হোঁচট খেতে হবে। অশনিসংকেতের মুখোমুখি হতে হবে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি না কমে বরং বাড়বে। 'কমন গ্গ্নোরি'কে রক্ষা করতে 'কমন ডেঞ্জার' থেকে রক্ষা পেতে দরকার নূ্যনতম সহাবস্থানের 'কমন গ্রাউন্ড'। ইরঢ়ধৎঃরংধহ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
জনকল্যাণের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি, মতের সমন্বয়-সম্মিলনে রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। সে বিবেচনায় এক দল আরেক দলের শত্রু কেন হবে, প্রতিপক্ষ হতে পারে। একই দলের একজন মানুষ আরেকজনের শত্রু কেন হবে, যদি প্রত্যেকে জনকল্যাণের আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনীতি করে। সবকিছুর পরও আমাদের অতীত কাতরতা, আচ্ছন্নতা, আবিষ্টতা থেকে সরে এসে সামনে এগোতে হবে। অহিংসবাদী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন, 'অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার দূর করা যায় না। একমাত্র আলোই পারে অন্ধকার তাড়াতে।' তার ভাষায়, 'উধৎশহবংং পধহহড়ঃ নব ফৎরাবহ ড়ঁঃ নু ফধৎশহবং, ড়হষু ষরমযঃ পধহ ফড় ঃযধঃ্থ.
অবিশ্বাস-সন্দেহের দেয়াল ভেঙে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, পরিবারে-সমাজে, দলাভ্যন্তরে, সরকার দল-বিরোধী দলে ব্রিজ স্থাপন করে সমন্বিতভাবে এগোতে হবে। আলোচনা বা ডায়ালগ ছাড়া কোনো সমস্যারই সমাধান হয় না। সরকার দল এবং বিরোধী দল যত দূরেই থাকবে ততই বিরোধ বাড়বে। রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। এ রাজনীতির মাধ্যমেই দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যবদল করতে হবে। রাজনীতিকে বদলাতে হবে, রাজনীতিবিদদের বদলাতে হবে। মানুষের কথা চিন্তা করে আমাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিতে হবে। ২০২১ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে কার্যকর করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যবদল, আমাদের মন্ত্রী-এপিদের ভাগ্যবদল নয়।
আমাদের রাজধানী ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, অপরিকল্পিত দুটি শহরের একটি। এ শহরটি ভূমিকম্প ঝুঁকির অন্যতম। হাইতিতে যে ভূমিকম্প হয়েছে, সেখানে এ পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপের মাত্র ৫ ভাগ সরানো গেছে। হিসাব করে দেখা গেছে, হাইতিকে পুরো পরিষ্কার করতে আরও ১৯ বছর লাগবে। এ প্রেক্ষাপটে ঢাকা শহরের কী অবস্থা_ আমরা কি ভাবতে পারি? এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। অন্যদিকে আমরা নিজরাই শহরটিকে ভূমিকম্পপ্রবণ করে তুলছি। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ছে এ শহর। এসব এক্ষেত্রে আইন করে সব ঠিক করা যাবে না। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। শক্তিশালী ও কর্তৃত্বসম্পন্ন কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে হবে। শুধু কর্তৃপক্ষ থাকলেই হবে না ক্ষমতাও দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন নতুন একটি সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা শুধু আমাদের নয়, তৃতীয় বিশ্বের আরও অনেক দেশ এ সমস্যা নিয়ে আতঙ্কিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সুন্দরবন-কক্সবাজারকে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যে স্থান দেওয়ার ক্যাম্পেইন ও রাজনীতি_ এটা আমাদের বুঝতে ও বিশ্বাস করতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিহিংসা, প্রতিপক্ষ যাই থাকুক না কেন এসব কমন সমস্যায় আমাদের এক হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তাই পুনর্বার বলি, সমস্বরে বলি_ সমঝোতাতে সমাধান, ঐক্যবুদ্ধিতেই সমৃদ্ধি।

ওবায়দুল কাদের চৌধুরী, এমপি :
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ
 

No comments

Powered by Blogger.