ঢাকা নগর-কার দৃষ্টি আকর্ষণ করব, প্রধানমন্ত্রীর? by এ কে এম জাকারিয়া

বিষয়, ঢাকা শহরের নাগরিক সমস্যার কিছু দিক। দেখার যেন কেউ নেই। মানে যাদের যেটা দায়িত্ব, সেই জায়গা থেকে তা পালন করা হচ্ছে না। এই অবস্থায় কার দৃষ্টি আকর্ষণ করব? উপায় থাকে একটাই—সবচেয়ে বড় পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা।


আমাদের অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে সবকিছুর জন্যই শীর্ষপর্যায়ের দ্বারস্থ হতে হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। ঢাকার নাগরিক সমস্যার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ কই? সমস্যা অনেক, আপাতত দুটি তুলনামূলকভাবে অনালোচিত বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা!

গ্যাস-সংকট, বৈষম্য
ঢাকার যে বাসায় এখন পাইপলাইনের গ্যাস-সংযোগ আছে, দুই চুলায় তাদের মাসিক খরচ ৪৫০ টাকা। এখন নতুন যত বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট হচ্ছে, সেখানে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। সিলিন্ডারের গ্যাসই তাদের ভরসা। বারবার সিলিন্ডার বদলানো, ভারী এসব সিলিন্ডার আনা-নেওয়া—এসব ঝক্কিঝামেলা বাদ, ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দামই পড়ে এক হাজার ৭০০ টাকার মতো। পরিবার খুব ছোট হলে দুটি আর বড় হলে তিনটি। গড়ে খরচ সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। পাশের বাড়িতে এক ফ্ল্যাটে যে পরিবার খরচ করছে মাসে ৪৫০, সেখানে অন্য আরেকটি পরিবার খরচ করছে অন্তত সাড়ে তিন হাজার টাকা। কমপক্ষে সাত গুণ বেশি। পরিবার বড় হলে তা ১১ গুণে গিয়ে ঠেকবে। এটা কি মেনে নেওয়ার মতো কোনো বৈষম্য? কিন্তু এভাবেই তো চলছে!
আর সিলিন্ডারের এলপি গ্যাসও যে আপনি সহজে পাবেন, তাও নয়। গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকায় সিলিন্ডারের চাহিদা বাড়ছে। সে অনুপাতে জোগান না বাড়ায় অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী দামও বেড়ে চলেছে। সরকার যে এলপি গ্যাস বিক্রি করে সেই সিলিন্ডারের নির্ধারিত দাম হচ্ছে ৭০০ টাকা, চাহিদার তুলনায় তাদের সরবরাহ এতই কম যে এই সিলিন্ডার আপনি পাবেনই না। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দামের কোনো সীমা নেই। একই মাপের সিলিন্ডার এখন বিক্রি হয় এক হাজার ৭০০ টাকায়। এই দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি দেখার কেউ নেই। এলপিজির জন্য প্ল্যান্ট করার কথা থাকলেও বর্তমান সরকারের তিন বছরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। বেসরকারি খাতেও হয়নি, সরকারি খাতেও না। এলপিজি খাত নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনাই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ‘গ্যাস ও এলপিজি সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হবে’—এই ছিল ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার।
বিদ্যুতের উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে এমন ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। কারণ, ‘কুইক রেন্টালে’ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে আমদানি করা ডিজেল দিয়ে। চাহিদামতো বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছে না, এ অবস্থায় দাম বাড়ালে জনগণ খেপবে, এই ঝুঁকি নিয়েই সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। মানে জনগণকে ভয় পাওয়ার অবস্থানে সরকার নেই। গ্যাসের ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান ভিন্ন কেন? পাইপলাইনের গ্যাস দিয়ে মাত্র ৪৫০ টাকা খরচ করে যেখানে একটি পরিবার সারা মাসের রান্নাবান্নার কাজ সারছে, সেখানে গ্রামে লাকড়ি ব্যবহার করে রান্না করতেও এর চেয়ে বেশি খরচ করছে একটি পরিবার। আমদানি করতে হয় না বলে গ্যাসের যেন কোনো দামই নেই!
গাড়িতে ব্যবহার করা সিএনজির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। প্রাইভেট কার বা নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করেন কারা? দেশের জনগণের মধ্যে যাঁদের টাকা-পয়সা খরচ করার সামর্থ্য সবচেয়ে বেশি। এসব গাড়ি ব্যবহারকারীদের এত কম দামে গ্যাস দেওয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে? পেট্রল ও অকটেনের সঙ্গে সিএনজির দামে ফারাকটা এখন আকাশ-পাতাল। দেখা যাচ্ছে, যিনি কোটি টাকার পাজেরো গাড়ি চালাতে পারেন, তাঁর গাড়িও সিএনজি স্কুটারগুলোর সঙ্গে গ্যাস নিতে লাইন দিয়েছেন সিএনজি স্টেশনে! কম দামে গ্যাস পাওয়ার কারণে অহেতুক গাড়ি ব্যবহার ও একাধিক গাড়ি ব্যবহারের ঘটনা বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবে আসলে হচ্ছেও তা-ই। তেল দিয়ে গাড়ি চালাতে হলে হয়তো অনেকেই হিসাব করে ও বুঝে-শুনে গাড়ি চালাতেন।
চাহিদার তুলনায় এখন আমাদের গ্যাসের সরবরাহ কম—এটা হচ্ছে বাস্তবতা। এমন অবস্থায় যা করা দরকার তা হচ্ছে, গ্যাসের সবচেয়ে কার্যকর ও দরকারি ব্যবহার নিশ্চিত করা। সরকার কম দামে গ্যাস দিতে পারে শুধু সে ক্ষেত্রেই, যেখানে সফলটি পাবে সাধারণ জনগণ। এখন যে দামে সিএনজি বিক্রি হয়, তা একমাত্র গণপরিবহনের ক্ষেত্রেই দেওয়া যেতে পারে; কারণ এর ফল পাবে সাধারণ জনগণ। প্রাইভেট গাড়ির ক্ষেত্রে এ সুযোগ দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। সন্দেহ নেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সমাজের এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ক্ষুব্ধ হবে; কিন্তু এ ছাড়া পথ কী! অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিও গণপরিবহন ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ের বিলাসবহুল গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার না করার পক্ষে মত দিয়েছে (প্রথম আলো, ৩ মে)।
বাজেট আসছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। গ্যাস সাশ্রয় করতে গণপরিবহন ছাড়া অন্য সব যানবাহনের সিএনজি বন্ধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এলপিজি সরবরাহ সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে বাজেটে আর্থিক ও নীতি-সহায়তার ঘোষণা থাকতে হবে। বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা পাইপলাইনের গ্যাসের দাম কীভাবে এলপিজির সঙ্গে সমন্বয় করা যায়, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে।

ঢাকার বৃক্ষ ও সড়কদ্বীপ
নগরে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে ফুটপাতগুলোই বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কারণ, এসব গাছ পথচারীদের ছায়া দিতে পারে। কিন্তু ঢাকা শহরের অবস্থা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে ফুটপাতে গাছ লাগানোর বিষয়টি আর ভাবা যাচ্ছে না। ফুটপাত এখন মানুষের হাঁটার উপযোগীই নেই। গাছ লাগানো হবে কোথায়? গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে সড়কদ্বীপগুলোই এখন একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় ঢাকার সড়কদ্বীপগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত ছিল। যানজট, সড়কের স্বল্পতা, সংকীর্ণ সড়ক—এসব কারণে সড়কদ্বীপগুলোকে ছোট করা হয়েছে। দু-একটি রাস্তা বাদে এখন সড়কদ্বীপগুলো গড়ে ফুট খানেকের বেশি হবে না। এদিকে নগরের সৌন্দর্য বর্ধন, বৃক্ষরোপণ এসব বাদ দেওয়া যায় না। শহরজুড়েই সড়কদ্বীপে লাগানো হয়েছে গাছ। কিন্তু এত ছোট জায়গায় কি আদৌ গাছ লাগানো যায়? লাগালেও কী গাছ? আর গাছ লাগানোর পর এখন এগুলোর অবস্থাই বা কী?
বৃক্ষপ্রেমী ও কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদের সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই এসব গাছ লাগানো হয়েছে। অপ্রশস্ত এসব সড়কদ্বীপে কোথাও লাগানো হয়েছে মেহগনির মতো বনজ গাছ। এমনকি অনেক সড়কদ্বীপে আছে বট ও অশ্বত্থের মতো গাছও! লোহার খাঁচা বানিয়ে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, কোথাও বাঁশ দিয়ে, কোথাও বা দড়ি দিয়ে এসব গাছ রক্ষার চেষ্টা হয়েছে। সব মিলিয়ে অধিকাংশ রাস্তার সড়কদ্বীপগুলোর এখন যা অবস্থা, তাতে আর যাই হোক সৌন্দর্য বর্ধন হচ্ছে না। সড়কদ্বীপগুলোর খোলা মাটি শুকনোর সময় ধুলা ও বর্ষার সময় কাদার জন্ম দিচ্ছে।
নগরে গাছ লাগানো বা গাছ দিয়ে নগর সাজানোর ক্ষেত্রে একটি পরিকল্পনা লাগে। যেখানে-সেখানে শুধু গাছ লাগিয়ে দিলেই হলো না। এসব নিয়ে কাজ করেন, চিন্তাভাবনা করেন এমন লোকের যে দেশে অভাব আছে, তা নয়। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের পরামর্শ নেবেন কেন? সেদিন প্রকৃতিপত্র নামের একটি পত্রিকায় এ নিয়ে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার একটি লেখা পড়লাম। ঢাকার সড়কদ্বীপের বৃক্ষসজ্জা যে কতটা অপরিকল্পিত হতে পারে সেটাই তাঁর লেখার বিষয়। নিসর্গ ও প্রকৃতিপ্রেমী দ্বিজেন শর্মাও বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে লিখেছেন। এসব নিয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে সন্ধান পেলাম স্থপতি মুশতাক কাদরীর। গাছ, বিশেষ করে নগরের গাছ নিয়ে রয়েছে তাঁর বিশেষ আগ্রহ। এ নিয়ে পড়াশোনা করেন নিয়মিত। বলা যায়, এ ব্যাপারে তাঁর এক ধরনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রয়েছে। ‘ঢাকা একটি অগণতান্ত্রিক শহর। এখানে শহরের পরিকল্পনা হয় গাড়ি আর যানবাহন দিয়ে, মানুষ দিয়ে নয়।’ ঢাকা নিয়ে তিনি তাঁর আক্ষেপের কথা জানালেন এভাবেই। বললেন, ‘ঢাকা শহর বৃক্ষ ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, এখন যদি আমরা সত্যিই বৃক্ষ দিয়ে ঢাকা শহরকে সাজাতে চাই, তবে অনেক দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’
জানতে চেয়েছিলাম ঢাকা শহরের সড়কদ্বীপের গাছ নিয়ে। বললেন, সড়কদ্বীপে গাছ লাগানোর প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে সঠিক স্থানে সঠিক গাছটি লাগানো। যে গাছটি আমরা লাগাতে চাই তার পরিবেশ আছে কিনা। দেখতে হবে যেখানে গাছ লাগানো হচ্ছে তার মাটির নিচে কী আছে, সুয়ারেজ বা গ্যাসের লাইন আছে কিনা, ওপরে বিদ্যুতের লাইনের কী অবস্থা। এ রকম আরও নানা কিছু। ভুল গাছ লাগিয়ে যাতে কেটে ফেলতে না হয় সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, একটি গাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে।
তিনি ঢাকা শহরে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে একটি গাইডলাইন তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। যেখানে কোথায় কোন গাছ লাগানো যাবে, সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য কোন ধরনের সড়কদ্বীপে কী ধরনের গাছ লাগানো যাবে, কোন গাছ লাগানো যাবে না—এসব নির্দেশনা থাকবে। এখন নগরের সড়কদ্বীপের গাছগুলো পরিচর্যা করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু সরকার যদি কোনো গাইডলাইন তৈরি করে দেয় তবে সেটি মেনেই গাছ লাগানোর কাজটি করতে হবে।
সরকার কি দেশের বৃক্ষপ্রেমী ও নিসর্গীদের ডেকে তাঁদের পরামর্শ নিয়ে এ ধরনের একটি গাইডলাইন তৈরি করতে পারে না? সরকার ডাকলে তাঁরা সানন্দেই যে এ কাজে সহায়তা দেবেন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। বৃক্ষরোপণের মাস আসছে, রীতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এই গাছ লাগানোর উৎসবের উদ্বোধন করবেন। গাছ লাগানোর বিষয়ে একটি গাইডলাইন করার ঘোষণা কি আমরা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আশা করতে পারি?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.