সুশাসন-চট্টগ্রামের নতুন মেয়রের জন্য কিছু পরামর্শ by মশিউল আলম

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনবারের নির্বাচিত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর নির্বাচনী কার্যালয়ে সাক্ষাতের সময় প্রশ্ন করেছিলাম, মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আপনি বিভিন্ন সময়ে একাধিক কাজের উদ্যোগ নিয়েছেন, যেগুলোর বিরুদ্ধে নগরবাসীর একাংশ প্রবল প্রতিবাদ করেছিল।
আপনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নগরবাসীর মতামত শোনার চেয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেন বলে অনেকে বলছেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে কি আপনার উচিত নয় সব সময় জনমতকে গুরুত্ব দেওয়া? উত্তরে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন, জনগণ তাঁকে ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচিত করেছে, অর্থাৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই জনগণ তাঁকে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কাজ করার ম্যান্ডেট দিয়ে দিয়েছে। এরপর আর সব সময় জনগণের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এম মন্জুর আলমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি যদি মেয়র নির্বাচিত হন, তাহলে কি একক সিদ্ধান্তেই সিটি করপোরেশন চালাবেন, না সময়ে সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত নেবেন এবং সেগুলো বিবেচনা করে দেখবেন? অমায়িক বিনয়ী হিসেবে পরিচিত মন্জুর আলম স্মিত হেসে বলেছিলেন, তিনি যদি মেয়র নির্বাচিত হন, তাহলে নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে, তাঁদের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবেন, কাজ করবেন।
১৭ জুনের নির্বাচনে এম মন্জুর আলম জয়ী হয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় গিয়েছিলেন সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে, তাঁর সহযোগিতা চাইতে। মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁকে সাদরে বরণ করেছেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। এটি অবশ্যই একটি প্রীতিকর ঘটনা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন ঘটনা বিরল। সে কারণেই সংবাদপত্রগুলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি প্রকাশ করেছে। এবারের সিসিসি নির্বাচনের কিছু প্রশংসনীয় দিক সবারই দৃষ্টি কেড়েছে। যেমন বিএনপিনর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এম মন্জুর আলম নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিলম্বে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মন্জুর আলমের দিক থেকে আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল এই যে, নির্বাচনী প্রচারণাকালে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে কুৎসামূলক প্রচারণায় তিনি নামেননি। যেদিন সন্ধ্যায় তাঁর নির্বাচনী কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম, সেখানে তাঁকে পরিবেষ্টন করে ছিলেন চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। কথার ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা যখনই মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে নিন্দামূলক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তখনই মন্জুর আলম বিব্রত হচ্ছিলেন, বিনয়ের সঙ্গে তাঁদেরকে নিন্দা পরিহার করতে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন।
সন্দেহ নেই, চট্টগ্রাম নগরবাসী একজন ভদ্রলোক মেয়র পেলেন, যাঁর স্বভাবে বহুলপ্রচলিত রাজনৈতিক কুটিলতা ও খেয়োখেয়ি দৃশ্যত অনুপস্থিত। তবে এসব গুণের সঙ্গে নেতৃত্বদানের দক্ষতা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা এবং সর্বোপরি নগরবাসীর পছন্দ-অপছন্দগুলোকে আমলে নেওয়ার মানসিকতা বিশেষভাবে দরকার। নির্বাচনের আগে তিনি নগরবাসীকে জানিয়েছিলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি তাঁদের জন্য কী কী করবেন। কিন্তু নগরবাসী কী চায় তা জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছিলেন কি না, করলে কী প্রক্রিয়ায় করেছিলেন তা জানি না। এ দেশের সব নির্বাচনেই এমনটি হয়ে থাকে। নির্বাচনে প্রার্থীরা ও তাঁদের দলগুলো কিছু প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার প্রকাশ করে জনগণের ভোট চান। সেসব প্রতিশ্রুতির তালিকায় থাকে সাধারণভাবে জনপ্রিয় বিষয়গুলো। ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন’ সে রকমই একটি সাধারণ জনপ্রিয় বিষয়। একজন সিটি মেয়র তাঁর নগরটিকে কী রূপে গড়ে তুলতে চান, অর্থাৎ এ বিষয়ে তাঁর ভিশন বা রূপকল্প কী, তা পরিষ্কার ছিল না। এখনো মেয়র মন্জুরের তেমন কোনো রূপকল্প আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য সে রকম একটি রূপকল্প আগে থেকে নিজেই স্থির করার চেয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের ভিত্তিতে গড়ে তোলাই শ্রেয়তর হবে। এখন মেয়র মন্জুরের সেই সময়।
মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে সিটি করপোরেশনকে প্রায় একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ফেলেছিলেন—এ রকম সমালোচনা গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মন্জুর আলম। মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরবাসীর ওপর করের বোঝা না বাড়িয়ে সিটি করপোরেশনের আয় বাড়িয়েছিলেন—এই ব্যাপারটির মধ্যে একটা প্যারাডক্স ছিল। করের বোঝা খুবই অজনপ্রিয়, সেটা না বাড়িয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী ধনী-গরিব নির্বিশেষে নগরবাসীর সবার ভালোবাসা পেয়েছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের আয় বাড়ানোর জন্য যে ব্যাপক বাণিজ্যিক তৎপরতা চালিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও চালাবেন বলেই প্রচার করছিলেন (কেননা তিনি চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে চান সিঙ্গাপুরের মতো করে), সেটা বেশির ভাগ লোকেই পছন্দ করেনি। আমি দৈবচয়ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন বয়স, লিঙ্গ ও শ্রেণী-পেশার ৫০ জন ভোটারের মতামত সংগ্রহের সময় এটা লক্ষ করেছিলাম: অধিকাংশ ভোটারই বলেছেন, সিটি করপোরেশনের আয় বাড়ানো ভালো, কিন্তু একশভাগ বাণিজ্যিকীকরণ ভালো নয়। মন্জুর আলম আমাকে বলেছিলেন, তিনি করও বাড়াবেন না, বাণিজ্যিকীকরণও করবেন না। দুটোর মাঝামাঝি থেকে চট্টগ্রামের উন্নয়ন করবেন। বিষয়টা ঠিক পরিষ্কার নয়। সিটি করপোরেশন কর না বাড়িয়ে কীভাবে আয় বাড়াতে পারে তা ব্যাখ্যা করার জন্য যে সময় প্রয়োজন, আমার সঙ্গে আলাপের ওই মুহূর্তে মন্জুর আলমের তা ছিল না। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই তাঁর কিছু বাস্তবভিত্তিক চিন্তা-ভাবনা থেকে থাকবে।
যাই হোক, মেয়র মন্জুরের এখন সিটি করপোরেশন পরিচালনার নীতি-কৌশলগত পরিকল্পনা করার সময়। এ সময় তিনি যদি স্মরণে রাখেন যে মেয়র নির্বাচিত করার মধ্য দিয়েই চট্টগ্রাম নগরবাসী তাঁকে সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগাম ম্যান্ডেট দিয়ে দেননি, বরং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জনমত গ্রহণ ও বিবেচনা করা উচিত, তাহলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভুল পদক্ষেপগুলো তিনি এড়াতে পারবেন এবং সেটাই গড়ে তুলবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সবচেয়ে কার্যকর ও ফলপ্রসূ কর্মপদ্ধতি। প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোর সবচেয়ে বড় যে সুবিধার কথা অ্যারিস্টটল বলতেন, সেটা হলো এই: ছোট ইউনিটের শাসনকাজ পরিচালনা অপেক্ষাকৃত সহজ ও অধিকতর গণতান্ত্রিক হতে পারে, কারণ সেখানে নাগরিকের সংখ্যা কম, প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। সেখানে সবার মতামত গ্রহণ ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ। আমাদের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সে রকম হতে পারত যদি শুধু নির্বাচনকালে নয়, সব সময় সংশ্লিষ্ট ইউনিটের জনগণের মতামত গ্রহণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো; যদি মনে করা না হতো যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ একজন প্রার্থীকে সবকিছু করার আগাম ম্যান্ডেট দিয়ে দেয়।
মেয়র মন্জুর আলম যদি সত্যিই সব সময় তাঁর নগরবাসীর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে চলতে চান, তাহলে জনমত সংগ্রহের কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের ৪১ জন নির্বাচিত কাউন্সিলর তাঁদের নিজ নিজ ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই মেয়র সাহেব যা বলবেন তাই হবে—এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে কাউন্সিলরদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। কাউন্সিলররা যেন মেয়রের বিরাগভাজন হওয়ার ভয় থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ওয়ার্ডের জনগণের পক্ষে মতামত প্রকাশ করতে পারেন, সে দিকে নজর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিল কার্যালয়ে একটি করে মতামত প্রদানকেন্দ্র খোলা উচিত, যেখানে ওয়ার্ডবাসীর বক্তব্য নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা থাকবে। এ ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধাগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে মেয়রের কার্যালয়ের থাকবে একটি ওয়েবসাইট, যেখানে শিক্ষিত নগরবাসীরা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নিজেদের মতামত, অভিযোগ, দাবি-দাওয়া ইত্যাদি জানিয়ে লিখতে পারবেন। এবং সেসব মতামত মেয়রকে নিয়মিতভাবে অবহিত করার স্থায়ী ব্যবস্থা থাকবে; মেয়র ও কাউন্সিলরদের সাধারণ সভায় সেসব নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হবে এবং সেসবের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এভাবে আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো শুধু ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্র চর্চার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে হতে পারে নাগরিক পর্যায়ের অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে গণতন্ত্র অনুশীলনের একেকটা মডেল। এই কাজে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হতে পারে অত্যন্ত সহায়ক। এবারের সিসিসি নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে (২১ নং ওয়ার্ড—জামালখান) ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভোটদানের ব্যবস্থায় বেশ সাড়া মিলেছে। ভবিষ্যতে অবশ্যই এ ব্যবস্থার প্রসার ঘটবে। সামনে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও নিশ্চয় অনেক ওয়ার্ডে এই ব্যবস্থা করবে নির্বাচন কমিশন।
সবকিছু মিলিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। চট্টগ্রামের নবনির্বাচিত মেয়র এম মন্জুর আলম যদি তাঁর নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে, সব সময় তাদের মতামত ও পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিটি করপোরেশন পরিচালনার চেষ্টা করেন, তাহলে চট্টগ্রাম থেকেই সূচিত হতে পারে আমাদের কাঙ্ক্ষিত, কার্যকর ও ফলপ্রসূ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার অগ্রযাত্রা। এবং তার কিছু ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হবে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.