খুলনার শিল্পাঞ্চলে প্রাণের স্পন্দন

খুলনার খালিশপুরে আবার ফিরে এসেছে প্রাণের স্পন্দন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে সেখানকার পিপলস জুট মিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া জোট সরকার এবং পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বেশ কয়েকটি পাটকলের আরো কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়।


সদ্য বেকার হওয়া এসব শ্রমিক এবং তাদের পরিবার-পরিজনের সেদিনকার আর্তনাদ আজও মনে পড়ে। বিভিন্ন সংগঠন মিলটি চালু করার পাশাপাশি বেকার হওয়া শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু তাতে তৎকালীন গদিনশিনদের হৃদয় বিগলিত হয়নি। অবশেষে বেকার শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মিল এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে খুলনার এই শিল্পাঞ্চলটির প্রাণচাঞ্চল্য প্রায় পুরোপুরি থেমে গিয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ মার্চ খালিশপুর জুট মিল নামে সাবেক পিপলস জুট মিলটির কার্যক্রম পুনরায় উদ্বোধন করেন। ফলে সেখানে আবার শুরু হয়েছে শ্রমিকদের কোলাহল, কর্মচাঞ্চল্য।
এটাই উন্নয়ন, এটাই সমৃদ্ধি এবং এটাই কাম্য। কোলাহলমুখর শিল্পাঞ্চলগুলো একের পর এক স্তব্ধ হয়ে যাবে_এমনটা ভাবা যায় না। বরং উত্তরোত্তর সেসব শিল্পাঞ্চল আরো সমৃদ্ধ হবে, এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে গণমানুষের প্রধানতম প্রত্যাশা। অথচ '৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো এর বিপরীত কাজগুলোই করে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে আদমজী এবং বাওয়ানীসহ যে ৭৭টি পাটকল ছিল, এখন তার এক-চতুর্থাংশও চালু নেই। বড় বড় পাটকলের প্রায় সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রির নামে লুটপাট করা হয়েছে। কারণ ১৯৯১ সালের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত টাস্কফোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, এর আগে বিক্রি করা ২৯টি পাটকলের মূল্য ছিল ২৪৫ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি টাকায়। সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বর্তমান সরকার নিতান্তই ধ্বংসস্তূপ থেকে আমাদের পাট শিল্পকে পুনরুদ্ধারের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তা অত্যন্ত মহতী একটি উদ্যোগ। এ থেকেও অনুমান করা যায়, দেশে এখন প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার বিদ্যমান। প্রধানমন্ত্রী শুধু খালিশপুর জুট মিলের কার্যক্রমই উদ্বোধন করেননি, একই সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছেন, বন্ধ থাকা আরো সাতটি পাটকল দ্রুত চালু করা হবে।
শুধু খুলনার শিল্পাঞ্চল নয়, দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলাও হয়ে পড়েছিল মৃতপ্রায়। প্রধানমন্ত্রী মংলা বন্দরেও নতুন করে প্রাণ সঞ্চারের উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতিমধ্যে নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ সেখান থেকে কমিশনিং করেছেন। বন্দরের উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মংলা বন্দর সঠিকভাবে চালু হলে নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হবে। পাশাপাশি বহু বাংলাদেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মংলায় দুই হাজার মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খুলনা তথা দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের মধ্যে যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা বিরাজ করছে, তাতে নিশ্চিত করে বলা যায়, তারা একটি স্বাধীন দেশে ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা কেবল হারিয়েছে, কেবল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তাই তাদের দীর্ঘদিনের সেই বঞ্চনার ক্ষতিপূরণ অবশ্যই করতে হবে।
পাটকে একসময় বলা হতো বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। সারা দুনিয়ায় আজ পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ অবস্থায় আমাদের পাটশিল্প পিছিয়ে থাকতে পারে না। পাট আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের পরিচিতির অংশ। আমরা পাটের জেনোম আবিষ্কার করেছি। উন্নত পাটবীজ উৎপাদনের গবেষণা চলছে। পাটজাত পণ্যের উৎকর্ষের জন্যও ব্যাপক গবেষণা চালাতে হবে। সদিচ্ছা থাকলে পাটশিল্পসহ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে আমরা এগিয়ে যাবই।

No comments

Powered by Blogger.