রাজধানী ঢাকা-কার্যকর ও বড় পরিকল্পনা এখনই জরুরি by নজরুল ইসলাম

বড় দুটো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। একটি তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িতে, আরেকটি পুরান ঢাকার নিমতলীতে আগুনে পুড়ে প্রায় ১১৭ জন মানুষের প্রাণহানি। দুটো ঘটনাই অত্যন্ত মর্মান্তিক ও দুঃখজনক। এখান থেকে আমরা ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। এখন এ রকম ঘটনা কেন হলো, কীভাবে হলো, সেটা আলোচনা করতে হবে।


ঢাকা ৪০০ বছর বয়সী এক পুরোনো শহর। ৪০০ বছরে অনেক বড় রকমের দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি এ শহরে ঘটেছে। আহছান মঞ্জিল পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এসব থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি। কায়েতটুলীর ঘটনা আমাদের ভীষণভাবে ভাবায়। মূলত ওখানে এমন এক ঘিঞ্জি পরিবেশ, যা যেকোনো বিপদের সামনে মানুষকে দুর্বল করে রাখে। এ আগুনের সূত্রপাত হয়তো রান্নার আগুন থেকে। একপর্যায়ে আগুন ছিটকে গিয়ে সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পরে পুরান ঢাকার জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ধারণা করা হয়, স্বাধীনতার পরে ঢাকায় ছিল নয় লাখ মানুষ। যে এলাকায় ওই নয় লাখ মানুষ ছিল, সেটুকু এলাকায় এখন নব্বই লাখ থেকে এক কোটি মানুষের বাস। অর্থাৎ দশ গুণ বেড়েছে।
রাজউকের আওতাধীন এক হাজার ৫৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এখন বাস করে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। আর ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) মধ্যেও রয়েছে সত্তর-আশি লাখ মানুষ। ডিসিসির থেকে বড় হলো ডিএমপি। এর মধ্যে বাস করে প্রায় এক কোটি মানুষ। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এর মধ্যে পুরান ঢাকার জনঘনত্ব আরও বেশি, প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় দুই লাখ মানুষ।
ঢাকা ১৫ কোটি জনসংখ্যার এক দেশের রাজধানী। এবং এ জনসংখ্যার ১৫ ভাগের এক ভাগ থাকে এ শহরে। এত বেশি মানুষের বাসস্থানে পরিকল্পিত নগরায়ণের কোনো চেষ্টা কি আমরা দেখি? ঢাকা যখন প্রাদেশিক রাজধানী ছিল, তখন এর জন্য প্রথম পরিকল্পনা করা হয়। তখন গঠন করা হয়েছিল ডিআইটি তথা ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট। তাদেরই ছিল দায়িত্ব। এর আগে দায়িত্ব ছিল সিটি মিউনিসিপ্যালটির। ডিআইটি করা হয়, যাতে কাজ ভালোভাবে হয়। এ রকমটা কলকাতা, দিল্লি, লাহোর, করাচি—সব জায়গায়ই হয়েছে। এর অধীনে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য ২০ বছর মেয়াদি বড় একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বা মাস্টারপ্ল্যান করা হয়। এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তান আমলের ১০ বছরে মোটামুটি এ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়। সে অনুসারে, বড় বড় সড়ক তৈরি করা হয়, সৃষ্টি করা হয় গুলশান-বনানীর মতো আবাসিক এলাকা, তেজগাঁওয়ে শিল্প এলাকা সৃষ্টি করা হয়। ষাটের দশকজুড়ে মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে এ পরিকল্পনা অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু ঢাকা যখন থেকে স্বাধীন দেশের রাজধানী হলো, তখন থেকে এ পরিকল্পনা আর অনুসরিত হলো না। রাজধানী হওয়ার জন্য জনসংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত বাড়তে থাকল। প্রতিবছর পাঁচ শতাংশ, সাত, এমনকি ১০ শতাংশ করে মানুষ বেড়েছে। সত্তর ও আশির দশক থেকে এভাবে অত্যন্ত উচ্চ হারে ঢাকার জনসংখ্যা বাড়তে থাকে।
পুরান ঢাকায় জনবসতি বেড়েছে, নতুন ঢাকায়ও নতুন নতুন এলাকায় শহর চারদিকে সম্প্রসারিত হয়েছে। সবদিকে এ শহর প্রসারিত হয়েছে। ১৯৮১ সালের লোকগণনায় ঢাকার জনসংখ্যা ১৬ লাখ, ১৯৯১-এ ৩৫ লাখ, ২০০১ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে সাভার পর্যন্ত ধরলে জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি হয়ে গেল। অথচ কোথাও কোনো পরিকল্পনা বা রূপরেখা অনুসরণ করা হলো না। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে আমরা সংবিধান পেলাম। দুই বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক রেহমান সোবহান এবং তাঁদের সঙ্গীরা মিলে জাতীয় উন্নয়নের পাঁচসালা পরিকল্পনা করে দিলেন। কিন্তু স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা করা হলো না। পুরোনো পরিকল্পনাকে প্রাসঙ্গিক করানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। আশির দশকে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাগজপত্র তৈরি হলো, প্রতিবেদন তৈরি হলো, কিন্তু অনুমোদন দেওয়া হলো না। ফলে আবার এটা স্থবির হয়ে গেল। এদিকে শহর বাড়তে থাকল। আবার ১৯৯২ সালে পরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলো। দ্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান নামে একটি পরিকল্পনা প্রণীত হলো। এটি মূলত একটি বিদেশি কনসালটেন্সি ফার্ম এবং দেশীয় সংস্থার মাধ্যমে হলো। এর মধ্যে ছিল একটা মাস্টারপ্ল্যান বা বৃহত্তর প্ল্যান। আর কেন্দ্রীয় ঢাকা বা ডিসিসির জন্য ছিল আরবান এরিয়া প্ল্যান। এটা ১৯৯৭-এ অনুমোদিত হলেও শর্ত ছিল যে দুটো পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয়ের জন্য ডিটেল এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ করতে হবে। এটা হলো বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা। এর উদ্যোগ নেওয়া হলো, কিন্তু কাজ এগোল না। তারপর সাত বছর চুপচাপ থাকার পর ২০০৪ সাল থেকে আবার শুরু হয়েছে। এখনো শেষ হয়নি। হয়তো বা শেষ হয়েছে, অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ড্যাপ অনুমোদিত না হওয়ায়ই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এত দিন লাগল কেন, সেটাই প্রশ্ন। আমার মনে হয়, প্রথম দিকে সরকারের পক্ষ থেকে রাজউকের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আবার যে বিদেশি সংস্থাটি এ কাজে ছিল, তারা ঠিকমতো কাজ করেনি। এতে এমন অনেক ত্রুটি ও ফাঁক ছিল যে তা বাস্তবায়ন হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো ছিল। অবশ্য কিছু স্বার্থান্বেষী মহল চেয়েছে, যাতে এ অবস্থায়ই এটা পাস হয়। তাতে তাঁদের সুবিধা। তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর সংশোধন করা হচ্ছে। আশা করি, এটা সংশোধিত হয়েই বের হবে এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো। নইলে পরিকল্পিত নগরোন্নয়ন হবে না।
এদিকে উন্নয়ন কিন্তু থেমে নেই। সাধারণ গৃহস্থরা, ডেভেলপাররা ভবন তুলছেনই। এগুলোর অনেকটারই অনুমোদন নেই। আবার এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনুমোদন নিয়েও যেসব ভবন তৈরি হয়, সেখানে অগ্নিনিরোধক-ব্যবস্থা বা ভূমিকম্প সহ্য করার মতো গঠন নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ভবন নির্মাণ বিধিমালাও অনুসরিত হয়নি। এ জন্য অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তদারককারী হিসেবে রাজউকের দায় আছে। আরও দায়ী মালিক এবং তাঁকে সহায়তাকারী স্থপতি ও প্রকৌশলী। নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় পরিষ্কার বলা আছে, মালিক, প্রকৌশলী ও স্থপতি—এ তিনজনই দায়ী থাকবেন। তাঁরা বাড়ি ব্যবহারযোগ্য হলো একটা অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট দেবেন। এর পর ভবনের ক্ষতি হলে দায় তাঁদের। এ ছাড়া অনুমোদন ও তদারকির প্রশ্নে রাজউক তো দায়ী থাকবেই।
আমরা জানি, রাজউক তার কর্তব্য সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। কিন্তু সব দোষ একেও দেওয়া যাবে না। রাজউকের জনবল ঘাটতি আছে, দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। তদারকি এবং নিয়ম মানানোর কাজটিতে তাদের আইনি ক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অনেক সময় আদালতের নির্দেশে কাজ বন্ধ করা যায়, আবার বাড়ি ভেঙে ফেলার বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশ এনে থামিয়ে বা দেরি করিয়ে দেওয়াও হয়।
বাস্তবায়নের দিকটি দেখার বেলায়ও ঘাটতি রয়েছে।
এখন জরুরি প্রয়োজন হলো, মহাপরিকল্পনা পাস হলে সেটা নিয়ে কাজে নেমে পড়া। কিন্তু বাস্তবে কাজ করা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট সরু, সেবামূলক ব্যবস্থা কম। এ রকম অবস্থায় কিছু সেখানে আর নতুন বাড়ি না করে শহরের নতুন নতুন এলাকায় চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। জনঘনত্ব কমাতে পর্যায়ক্রমে নতুন জায়গায় স্যাটেলাইট টাউন করে হোক বা যেভাবেই হোক, সেসব জায়গায় মানুষকে পাঠাতে হবে। এর বেশির ভাগ এলাকাকে ভেঙে পুনর্গঠন করতে হবে। একসময় সিঙ্গাপুর পুরোনো ঘরবাড়ি নিয়েই ছিল। এখন সেখানে কিছুই পাওয়া যাবে না। গোটা সিঙ্গাপুর ভেঙে নতুন করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের নগর কর্তৃপক্ষের নাম কিন্তু ডেভেলপমেন্ট দিয়ে নয়, তারা বলে রিডেভেলপমেন্ট অথরিটি। অর্থাৎ সর্বক্ষণ তারা এ পুনর্নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
নগরের নবায়নের এ চিন্তা ষাটের দশকে ডিআইটির ছিল। কিন্তু পরে এ চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে ব্যক্তি-উদ্যোগে পুনর্নবায়ন কিন্তু অহরহ হচ্ছে পুরান ঢাকায়। অথচ দরকার ছিল একটার পর একটা ব্লক নিয়ে ভেঙে নতুন করে বানানো এবং তার মধ্যে দিয়ে চওড়া রাস্তা বের করে করা। ভেঙে বানালে খরচ বাড়ে ঠিকই, কিন্তু সঠিকভাবে করলে সবাই লাভবান হয়। পাশাপাশি ঢাকার চারপাশে উপশহর বানাতে হবে। এ স্যাটেলাইট টাউন কি ঢাকার চারপাশের পুরোনো শহরে হবে নাকি একেবারে নতুন জায়গায় হবে? এর সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক ও যোগাযোগ কী হবে, সেটা ঠিক করতে হবে।
এত মানুষ কোথায় যাবে? তাদের সারা দেশে ছড়িয়ে রাখার সুযোগ রাখতে হবে। মানুষ সেখানেই যাবে, যেখানে অর্থনীতি শক্তিশালী এবং যেখানে সব সেবা পাওয়া যায়। সারা দেশ নিয়ে এমন পরিকল্পনা করতেই হবে। আগামী ২০ বছরে যদি ২৫ কোটি হয়, তার ব্যবস্থাপনা কঠিন। আরও বৃহত্তর পরিবেশে বিকেন্দ্রীকরণের চিন্তা করতে হবে। প্রতিবছর যে চার-পাঁচ লাখ মানুষ ঢাকায় আসে, তাদের বিভাগীয় শহরে, জেলা শহরে, এমনকি থানা শহরে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শক্তিশালী বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া নিশ্চিত হবে না। বেশ শক্তিশালীভাবে এ কাজে নামতে হবে। জনসংখ্যা যতই সম্পদ হোক, তাকে সীমিত রাখতেই হবে। এ অগ্নিকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে ঢাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে এখনই চিন্তা করতে না পারলে বিপদ আছে। খুব উচ্চপর্যায়ের সমন্বিত চিন্তাভাবনা জরুরি ভিত্তিতে এখনই করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে একটা সমন্বয় পরিষদ বা কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে। এবং সেখানে একজন পূর্ণ সময়ের জন্য পূর্ণ মন্ত্রী থাকা প্রয়োজন। তাঁর সঙ্গে মেয়ররা থাকবেন, কাউন্সিলররা থাকবেন, বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। এখনই মন্ত্রিসভা জরুরিভাবে বসে কাজের নির্দেশনা ঠিক করতে হবে। আমরা যাঁরা ওয়াকিবহাল, যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত, তাঁরা খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছি। বৃহত্তর সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা এখন নিতেই হবে।
এ রকম ঘটনা বারেবারেই ঘটবে। ভূমিকম্প হলে তো সর্বনাশ। এগুলো আমলে আনতে হবে। নদী দখল, মাঠ দখল, এসব জরুরিভাবে বন্ধ করতে হবে। সময় চলে যাচ্ছে, ঢাকার ভবিষ্যৎ দেশেরই ভবিষ্যৎ।
নজরুল ইসলাম: নগর পরিকল্পনাবিদ; চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।

No comments

Powered by Blogger.