শিশুদের জন্য 'চাপহীন' আনন্দদায়ক শিক্ষা চাই by হাফিজুর রহমান কার্জন ও ফারহানা হেলাল মেহতাব

শিশুরা হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ। এ কথা ছোটবেলায় আমরা যেমন পড়েছি, তেমনি প্রতিনিয়ত শুনতেও পাই। পড়া ও শোনার বাইরেও এখন মন থেকে উপলব্ধি করি, শিশুরা সুস্থ-স্বাভাবিক থাকলে জাতিও সুস্থ-স্বাভাবিক থাকবে। শিশুরা বাঁচলে জাতিও বাঁচবে।


কিন্তু আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক, আমরা যারা বাংলাদেশকে পরিচালনা করছি, তাদের অনেক বড় একটি ঘাটতির জায়গা হচ্ছে, আমরা আমাদের শিশুদের সুস্থ পরিবেশ দিতে পারছি না। শিশুদের খেলার মাঠ নেই, বেড়ানোর জায়গা নেই, সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নেই। এত বড় ঢাকা শহর। এ শহরে এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বসতি। আবাসিক এলাকায় আমরা এমনভাবে পাকা ইমারত নির্মাণ করছি, একটি ভবন আরেকটি ভবনে আলো-বাতাস প্রবেশ করার পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। খুপরির মতো ঘরগুলোতে বাস করতে করতে আমরা বিরক্ত হয়ে পড়েছি, হাঁপিয়ে উঠেছে আমাদের শিশুরা। দিন শেষে যখন বাচ্চারা মা-বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, 'আব্বু-আম্মু, আমাকে একটু বাইরে থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো', তখন গভীর এক অপরাধবোধ গ্রাস করে নেয় আমাদের! একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পর তার খাবার দরকার, পুষ্টি দরকার, ঘরে ও বাইরে সুস্থ পরিবেশ দরকার। বুঝতে শেখার পর থেকে জীবনের অন্য সব প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মায়ের সার্বক্ষণিক সাহচর্য দরকার, বাবার আদর ও সানি্নধ্য দরকার। কিন্তু চাকরিজীবী মা-বাবা তাঁদের বাচ্চাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। ফলে বাচ্চারা বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের সুস্থ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কখনো কখনো চাকরিজীবী মা-বাবার বাচ্চারা এতটাই অবহেলার শিকার হচ্ছে, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়ছে। কখনো কখনো এসব অবহেলিত বাচ্চা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কোনো কোনো বাচ্চা জড়িয়ে পড়ছে খুনের মতো নির্মম ও জঘন্যতম অপরাধে।
একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পর শারীরিক ও মানসিক পরিপক্বতা অর্জন না করা পর্যন্ত মা-বাবাকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। কেননা, প্রত্যেক বয়সের রয়েছে একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। পাঁচ বছর অবধি প্রতিটি শিশু পর্যাপ্ত আদর, মমতা ও যত্ন চায়। বিশেষ করে মা-বাবার সানি্নধ্য ও সাহচর্য প্রতিটি শিশুর সুস্থ-স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। পাঁচ বছর বয়সের পর স্কুলে যাওয়ার মাধ্যমে তার বাইরের জগতের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাচ্চাদের জন্য স্কুলের পরিবেশ, শিক্ষক, কাদের সঙ্গে সে মেলামেশা করছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা খারাপ পরিবেশ ও অসৎ সঙ্গ বাচ্চাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্যুত করে দিতে পারে। এরপর রয়েছে 'টিনএজ'। এই 'টিনএজ' যেকোনো এক সন্ধিক্ষণ। এই বয়সের উত্তাপ, উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগ অত্যন্ত বিপজ্জনক। 'টিনএজ'-এর ছেলেমেয়েদের ঠিকঠাকভাবে পরিচালনা করা না গেলে তারা বিচ্যুতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে পারে। তবে ছেলেমেয়েদের চোখে চোখে রাখা বা তাদের ওপর নজরদারির চেয়ে উত্তম হচ্ছে ছেলেমেয়েদের বন্ধু হয়ে ওঠা। মা-বাবা যদি ছেলেমেয়েদের ভালো বন্ধু হতে পারেন, তাহলে ছেলেমেয়েরা তাদের সব কিছু মা-বাবার সঙ্গে 'শেয়ার' করতে শিখবে। এতে জীবনের সুস্থ-স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে হারিয়ে বা ঝরে পড়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে।
আগেই উল্লেখ করেছি, একটি শিশুর জন্য স্কুলের পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় স্কুল থেকে। আর শিশুর চরিত্র গঠনে শিক্ষার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা। একটি শিশু বিনয়াবনত হবে, না উদ্ধত হবে, একটা শিশু শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে, না বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যপ্রিয় হবে_তার গুরুত্বপূর্ণ পাঠ কিন্তু একটা শিশু স্কুল থেকে পেয়ে থাকে। স্কুলের শিক্ষা কোমলমতি বাচ্চাদের আচরণ ও চিন্তাভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের স্কুলের পরিবেশ শিশুবান্ধব নয়। স্কুলে যাওয়ার প্রাথমিক উৎসাহ-উদ্দীপনা উবে যাওয়ার পর অনেক শিশুর কাছে স্কুল এক ভীতির কারণ হয়ে ওঠে। কেননা আমাদের স্কুলগুলোর পরিবেশ আনন্দদায়ক নয়। রাগী রাগী শিক্ষক, পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের অভাব, নিরানন্দ পাঠদান পদ্ধতি_এই হচ্ছে আমাদের স্কুলগুলোর সাধারণ চিত্র। রাজধানীর অনেক স্কুলে বাচ্চাদের ওপর যে পড়াশোনার চাপ দেওয়া হয় তা অস্বাভাবিক। বাচ্চাদের ওপর এতটা চাপ দেওয়া উচিত কি না, বাচ্চারা এতটা চাপ নিতে পারছে কি না, তা বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারণ না করেই আমরা বাচ্চাদের ওপর বিশাল এক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাচ্চারা ছুটছে স্কুলে। স্কুল থেকে ফেরার পর কোচিং বা প্রাইভেট টিউটর। রাতে আবার হোম টাস্ক। এতটা 'স্ট্রেস' নেওয়ার পর বাচ্চাদের কোনো খেলার মাঠ নেই, বেড়ানোর জায়গা নেই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। আমাদের বাচ্চারা কী করে সুস্থ আছে সেই তো এক আশ্চর্যের বিষয়! উন্নত দেশগুলোতে বাচ্চাদের স্কুলের পরিবেশ অত্যন্ত আনন্দদায়ক এবং শিক্ষকরা বাচ্চাদের প্রতি বন্ধুসুলভ। ওখানকার স্কুলগুলোতে বাচ্চাদের শুধু তাত্তি্বক জ্ঞানই দেওয়া হয় না, বরং স্কুল থেকেই বাচ্চাদের 'প্রবলেম-সলভিং স্কিল' বা সমস্যা সমাধানের পারঙ্গমতা শেখানো হয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ওই সব দেশের স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা এত সুন্দর করে শেখান, স্কুলের পর কোনো কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের প্রয়োজন হয় না।
একটা দেশ কতটা সভ্য, তা নির্ণয় করার কয়েকটি মানদণ্ড রয়েছে। এর একটি হচ্ছে, একটি জাতি তার শিশুদের কতটা সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ দিতে পারছে। যে জাতি তার শিশুদের যতটা সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ দিতে পারে, সে জাতি ততটা সভ্য। এই মানদণ্ডে আমাদের অবস্থান কোথায়? প্রত্যাশা করব, শিশুদের জন্য সুস্থ, সুন্দর, আনন্দদায়ক ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার জন্য আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করব। শিশুদের জন্য একটি 'বাসযোগ্য পৃথিবী' গড়ে তোলার দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের তা করতে হবে।

লেখকদ্বয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধ বিজ্ঞান গবেষক এবং সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.