এভারেস্টে আরেক বাংলাদেশি নারী by পল্লব মোহাইমেন

ঠিক এক সপ্তাহ পর আবার বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ল পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। এবার পতাকা ওড়ালেন আরেকজন বাংলাদেশি নারী—ওয়াসফিয়া নাজরীন। গতকাল ২৬ মে স্থানীয় সময় সকাল ছয়টা ৪১ মিনিটে তিনি এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন।
১৯ মে সকাল সাড়ে নয়টায় নিশাত মজুমদার প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেছিলেন।
পৃথিবীর সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয়ের (সেভেন সামিট) জন্য ওয়াসফিয়া নাজরীনের কর্মসূচি ‘বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট’-এর মুখপাত্র করভি রাখসান্দ সকাল সোয়া সাতটার দিকে প্রথম আলোকে এই খবর জানান। তিনি বলেন, ‘এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের পর স্যাটেলাইট টেলিফোনে ওয়াসফিয়া আমাকে এ খবরটা দেন। তিনি মাত্র ৩০ সেকেন্ড কথা বলেছেন।’
এভারেস্ট অভিযানের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজের ফেসবুক পাতায় হালনাগাদ তথ্য দিয়েছেন ওয়াসফিয়া। সেসব তথ্য থেকে জানা যায় প্রতিকূল আবহাওয়া ও তাঁর বিপৎসংকুল যাত্রার কথা। হিমালয়ের নেপাল অংশে দক্ষিণ দিক (সাউথ ফেস) দিয়ে তিনি অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে পড়া, রশি বাঁধতে গিয়ে শেরপাদের আহত হওয়া—বিপদ-আপদ কম যায়নি ওয়াসফিয়ার ওপর দিয়ে। তাই তো চূড়ান্ত বিজয় তাঁর খানিকটা বিলম্বিত হলো। এভারেস্ট অভিযান শুরু করেছিলেন গত ২৬ মার্চ।
ওয়াসফিয়ার এই এভারেস্ট অভিযানের আয়োজক এক্সপিডিশন হিমালয়া ডট কম (প্রা.) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নবীন ত্রিতালের সঙ্গে সকালেই মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়াসফিয়া এবং তাঁর সহযোগী তিন শেরপা—নিমা গিরিং, দা কুশাং ও ফুরা দর্জি এভারেস্ট চূড়া জয় করেছেন। তাঁরা শুক্রবার রাত আটটায় এভারেস্ট চূড়ার দিকে যাত্রা শুরু (সামিট পুশ) করেছিলেন।’ এভারেস্ট জয়ের পর ওয়াসফিয়া নাজরীন সাউথ কোলের পথে নামতে শুরু করেন বলে নবীন ত্রিতাল জানান। গতকাল রাতে তাঁর সাউথ কোলে অবস্থান করার কথা। আজ রোববার ক্যাম্প-২ এবং কাল সোমবার ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট বেসক্যাম্পে নেমে আশার কথা। ওয়াসফিয়া শারীরিকভাবে সুস্থ এবং নিরাপদ আছেন—জানান নবীন ত্রিতাল।
এভারেস্ট বিজয়ের সংবাদ পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফোনে কথা হয় ওয়াসফিয়ার মা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মালিহা এইচ চৌধুরীর সঙ্গে। ফোন ধরার পরই আনন্দে কেঁদে ফেলেন তিনি। বলেন, ‘ওর বিজয় আমাদের সবার বিজয়। আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে। ওয়াসফিয়া ফেসবুকে যেটা বলেছে, সাতটা চূড়ায় আমাদের পতাকা ওড়াবে—এতে আমি খুব গর্বিত। সবার আশীর্বাদেই ও এভারেস্ট জয় করেছে।’ ওয়াসফিয়ার বাবা নাজমী জামান চৌধুরী বাংলাদেশে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফরএভার লিভিং প্রডাক্টসের কান্ট্রি হেড। তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে নিশাত মজুমদার, আজ (গতকাল শনিবার) ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট জয়—বাংলাদেশের মেয়েরা যে এগিয়ে যাচ্ছে, তা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। ওয়াসফিয়া বাংলাদেশের নারীদের ইতিবাচকভাবে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে চায়।’
নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাস ওয়াসফিয়া নাজরীনকে অভিনন্দন জানিয়েছে। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অবস্থানরত আমাদের প্রতিনিধি তৌহিদা শিরোপা জানান, বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার ও ডেপুটি চিফ অব কমিশন এম ফরহাদুল ইসলাম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এই পর্বতারোহীকে। এম ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুনেছিলাম ওয়াসফিয়া নাজরীন এভারেস্ট অভিযানে এসেছেন। আজ জেনেছি তিনি সামিট করেছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ দূতাবাস এ বিষয়ে এখনো কিছু জানে না।’
তৌহিদা শিরোপা আরও জানান, বেসক্যাম্প থেকে কাঠমান্ডুর পথে যাত্রা শুরু করেছেন নিশাত মজুমদার এবং এম এ মুহিত। আগামীকাল তাঁদের কাঠমান্ডু এসে পৌঁছানোর কথা।
এভারেস্ট বিজয়ের মাধ্যমে ওয়াসফিয়া সেভেন সামিটের তিনটি চূড়া জয় করলেন। এর আগে গত বছরের ২ অক্টোবর তিনি আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমানজারো এবং ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত অ্যাকোনকাগুয়া জয় করেন। এর আগে জুলাই মাসে ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত এলবার্সের চূড়ার ৩০০ মিটার নিচে থেকে খারাপ আবহাওয়ার জন্য ফিরে আসেন ওয়াসফিয়া। তিনি ২০০৯ সালে নেপালের লু রী পর্বত, ২০১০ সালে আইল্যান্ড পিক জয় করেন।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তির সাল ২০১১-এ ওয়াসফিয়া সেভেন সামিটের ঘোষণা দেন। প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট ফাউন্ডেশন। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের নারীর শক্তি পৃথিবীর কাছে তুলে ধরা। শুরু থেকেই ওয়াসফিয়ার এই কর্মসূচির প্রতি সমর্থন দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘দুজন মেয়ে বাংলাদেশকে এই উচ্চতায় পৌঁছে দিল, যা আমাদের জন্য বড় ব্যাপার। তাঁরা চূড়ায় আরোহণ করেছেন—এ শুধু গর্ব নয়, দেখারও বিষয়। নতুন প্রজন্ম দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আমাদের উচিত তাদের কথা শোনা।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেক ট্রাস্টি সারা যাকের বলেন, ‘আমি আশা করছি, ওয়াসফিয়া নিরাপদে ফিরে আসবে। নিশাত এবং ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট বিজয় মেয়েদের জন্য বড় সাহসী উদ্যোগ। ওয়াসফিয়া শুধু পর্বতারোহণই করছে না, সে আদর্শকেও তুলে ধরছে।’
বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীম অভিনন্দন জানিয়েছেন ওয়াসফিয়া নাজরীনকে। তিনি বলেন, ‘যা আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল, এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুজন বাংলাদেশি নারী এভারেস্ট জয় করে তা বাস্তব করে দিলেন। এর ফলে আমাদের মনের আগল খুলে যাবে।’
১৯৮২ সালের ২৭ অক্টোবর ঢাকায় ওয়াসফিয়ার জন্ম। তাঁর দাদার বাড়ি ফেনী। ঢাকার স্কলাসটিকা স্কুল থেকে ও এবং এ লেভেল সম্পন্ন করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় এগনেস স্কট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। তাঁর বিষয় ছিল সামাজিক মনোবিজ্ঞান ও স্টুডিও আর্ট। এরপর স্কটল্যান্ডে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবনে তিনি যুদ্ধবিরোধী এবং মানবতার পক্ষে বিভিন্ন বৈশ্বিক ইস্যুতে সক্রিয় আন্দোলনকর্মী ছিলেন। তিনি উন্নয়নকর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন। এখন তিনি বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট কর্মসূচিতেই সময় দিচ্ছেন। তাঁর মেন্টর হিসেবে আছেন পৃথিবীর প্রথম সেভেন সামিট বিজয়ী কানাডার প্যাট্রিক মোরো।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর...’। বাংলাদেশের এভারেস্ট বিজয়ের ক্ষেত্রে এ কথাটা এখন আক্ষরিক অর্থেই মিলে যায়। গতকাল ওয়াসফিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে এখন এভারেস্ট বিজয়ী হলেন চারজন। এর মধ্যে দুজন নারী—নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরীন এবং দুজন পুরুষ—মুসা ইব্রাহীম ও এম এ মুহিত। মাত্র চারজনের মধ্যে নারী পুরুষের সংখ্যাগত সমতা একটা বড় অর্জন। এম এ মুহিত গত বছরের ২১ মে এবং গত ১৯ মে প্রথম বাংলাদেশি নারী নিশাত মজুমদারের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো এভারেস্ট জয় করেছেন।
ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট অভিযানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড এবং সহযোগী পৃষ্ঠপোষক রেনেটা ও কাজী ফার্মস।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এক অভিনন্দনবার্তায় গতকাল বলেন, ‘এই অসাধারণ সাফল্যের জন্য তাঁকে আমি হূদয়ের সমস্ত উষ্ণতা দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, এই বিজয়ের মাধ্যমে সাতটি সুউচ্চ শৃঙ্গের মধ্যে ওয়াসফিয়া তিনটি বিজয় সমাপ্ত করলেন। তাঁর বাকি স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক, এই কামনা করেন ড. ইউনূস।

No comments

Powered by Blogger.