শ্রদ্ধাঞ্জলি-মোজাফ্ফর স্যার, এক প্রবাদপুরুষের প্রতিচ্ছবি by আবদুল মান্নান

১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে যখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিলাম, তখন আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়াও তিনজন মানুষ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে অভিনন্দন জানান। প্রথমজন আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ ফারুক।


স্যার আমাকে ছাত্রজীবন থেকেই অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তাঁর একাধিক গবেষণাকর্মে আমাকে কাজে লাগিয়েছেন। দ্বিতীয়জন প্রতিবাদী লেখক আহমদ ছফা। তাঁর সঙ্গেও আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে। মধ্য ষাটের দশকে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের পেছনে শরিফ মিয়ার ছোট ছাপরাঘরের ক্যানটিনকে ঘিরে নিয়মিত কবি-লেখকদের আড্ডা হতো। আলাপকালে আবিষ্কার হলো, আমরা দুজনই চট্টগ্রামের সন্তান। আহমদ ছফার লেখনী কিছুটা ভিন্ন ধারার হলেও তা ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং তাঁর আচার-ব্যবহারও ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমার উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই দুজন ব্যক্তি আমাকে চিঠি লিখে অভিনন্দন জানান এবং সাফল্য কামনা করেন। ছফা ভাইয়ের চিঠির শুরুটা ছিল এ রকম, ‘জীবনে এই প্রথমবার কাউকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখছি।’ আর শেষজন ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিনি ড. মোজাফ্ফর আহমদ। তিনজনই এখন প্রয়াত।
২০০৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আমি মোজাফ্ফর স্যারের প্রতিবেশী। দেখা হতো নিয়মিত। কখনো মসজিদে আবার কখনো বা পথে। স্যার যদিও আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু বাস্তবে তিনি শিক্ষকের চেয়েও অনেক বেশি ছিলেন। স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আশির দশকে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ব্যবস্থাপনা শিক্ষা উন্নয়ন-বিষয়ক একটি প্রকল্পে। তিনি কয়েক বছরের জন্য এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমিও তাঁর সহযোগী। স্যারের সঙ্গে কাজ করার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক করা যেত এবং তিনি আমার যুক্তিতর্ক সহজে গ্রহণ করতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার তিনি প্রফেসরদের নির্বাচনী বোর্ডে একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য হয়ে এসেছিলেন। আমিও সেই বোর্ডের একজন সদস্য। তিনজনকে প্রফেসর পদে পদায়নের জন্য নির্বাচিত করা হলো। গোল বাধল তাঁদের ক্রমবিন্যাস নিয়ে। স্যার প্রার্থীদের দীর্ঘদিনের সিনিয়রিটির বিন্যাস একটু পরিবর্তন করতে চাইলেন। অন্যরা চুপ। কারণ কেউই স্যারের মতের সঙ্গে দ্বিমত করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। আর আমার সঙ্গে স্যারের যে রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল, অন্যদের তা ছিল না। আমি স্যারের ক্রমবিন্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করলাম এবং আমার মতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলাম। স্যার চেষ্টা করলেন আমাকে নিবৃত করতে। আমিও কিছুটা নাছোড়বান্দা। শেষে স্যারের উক্তি ‘মান্নানের সাথে যুক্তিতে পারা যায় না।’ শেষতক আমার যুক্তিমতো সিদ্ধান্ত হলো। স্যারের ওই উক্তি সম্ভবত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রশংসা। এমন প্রশংসা করার মানুষটি ২২ মে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য না-ফেরার দুনিয়ায় চলে গেলেন।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর স্যার একটি বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, শেষ করেছেন সমাজের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে। সব সময় প্রশংসিত হয়েছেন তা নয়, কখনো কখনো সমালোচিতও হয়েছেন। কাজ করতে গেলে সমালোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ সব মানুষ সমালোচনার ঊর্ধ্বে মহামানব বা অতিমানব হতে পারে না। আর বাঙালির সমস্যা হচ্ছে যাঁর সমালোচনা করা হচ্ছে, তিনি এই কারণে না যতটা অসন্তুষ্ট হন, তার স্তাবকেরা হন তার চেয়েও অনেক বেশি। স্তাবকতন্ত্র এ দেশে একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকে তা পছন্দও করেন এবং তাতে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন।
২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলো। তা নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে গেল। স্যার আবার এই সংস্থার (টিআইবি) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান। টিআইবি আবার নিজ দেশের রিপোর্ট প্রস্তুত করে না। তারা বড়জোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। ওইবার বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এই দুর্নীতিসূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করতে ১৪টি উপাত্তের প্রয়োজন হয় এবং সে বছর বাংলাদেশের রিপোর্টটি আটটি উপাত্ত দিয়ে তৈরি হয়েছে। মূল রিপোর্টে তা উল্লেখও আছে। সরকারের লোকজন সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদ বা রিপোর্ট প্রকাশিত হলে প্রথমে যে কাজটি করে তা হচ্ছে সরাসরি অস্বীকার করা। সেবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আর বাস্তবতা হচ্ছে সবগুলো উপাত্ত থাকলে কি বাংলাদেশের দুর্নীতিসূচকের কোনো পরিবর্তন হতো? সম্ভবত না। যার প্রমাণ পরবর্তী চার বছরের সূচক। স্যারকে একবার আমি ওই প্রথম সূচকের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি আমাকে বলেছিলেন, ওই রিপোর্ট প্রস্তুতে তাঁদের কোনো হাত ছিল না, তাঁরা শুধু তা প্রকাশ করেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে (ডেপুটি চেয়্যারম্যান)। ওই কমিশনে অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ড. মোজাফ্ফর আহমদ, ড. মুহম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিরা। সদস্য ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতো অর্থনীতিবিদেরা। বঙ্গবন্ধুর অনেক অসাধারণ গুণের মধ্যে একটি বড় গুণ ছিল তিনি কাজের মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারতেন আর ঠিকই বুঝতে পারতেন কাকে দিয়ে কী কাজ হবে। কখনো তিনি ছাগল দিয়ে হালচাষ করতে চাইতেন না, বর্তমানে যেমনটি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর এই গুণটি তাঁর পরম শত্রুও স্বীকার করবেন। সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় কাজে লাগানোর ফলে তিনি সাড়ে তিন বছরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আবার নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। তিনিই ছিলেন এই রকম গুণে গুণান্বিত বাংলাদেশের শেষ রাষ্ট্রনায়ক। সেই মোজাফ্ফর স্যারকে দেখি সামরিক শাসক জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হতে, যেমনটি হয়েছিলেন বাংলার বিবেক হিসেবেখ্যাত অধ্যাপক আবুল ফজল অথবা জিয়ার সঙ্গে খাল কাটতে গিয়েছিলেন এ দেশের অনেক বামপন্থী নেতা। তবে আবুল ফজল বা মোজাফ্ফর স্যার জিয়ার সঙ্গে বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। সামরিক শাসকদের সঙ্গে ভদ্র এবং স্বাধীনচেতা মানুষদের কাজ করতে পদে পদে অসুবিধা হয়। সম্ভবত প্রথম দিকে তাঁরা গিয়েছিলেন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাঁদের হতাশার কারণে। মোজাফ্ফর স্যার এক-এগারোপরবর্তী মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের প্রতিও তাঁরা সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি তা প্রকাশ্যেই করেছিলেন, অন্য অনেকের মতো গোপনে নয়। এটি স্যারের একটা বড়গুণ। তাঁর কাছে একবার জানতে চাইলাম এই বিষয়ে তাঁর মন্তব্য। তিনি অকপটে জানালেন, তিনি মনে করেছিলেন এক-এগারোর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন হবে। সেটি তাঁর ভুল ধারণা ছিল।
স্যার যুক্ত ছিলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, সুজন বা বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে। তাঁর অনেক আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত থাকলেও আমি সব সময় বিশ্বাস করেছি, তিনি যা করছেন তা সরল বিশ্বাসেই করছেন, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে নয়; যা অনেকে করতে অভ্যস্ত। কখনো কখনো মনে হয়েছে তাঁকে কেউ কেউ ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। একবার আমার কন্যাকে নিয়ে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি এ ব্যাপারে আমাকে দু-একটি কথা বলেছিলেন, যা বোধগম্য কারণেই এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। মোজাফ্ফর স্যার খুবই ধর্মপরায়ণ মানুষ ছিলেন, কিন্তু কখনো ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি ও আমি একই মসজিদে নামাজ পড়তে যেতাম। রমজানের তারাবির নামাজের সময় লোডশেডিংয়ের কারণে মসজিদের ভেতর অসম্ভব গরম। স্যার চেয়ারে বসে নামাজ পড়তেন। দেখি তিনি কোনো সংকোচ না করে গায়ের জামাটা খুলে নামাজ শেষ করলেন। তাঁকে ওই মসজিদে আর কখনো দেখা যাবে না। আর কখনো সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শেষে কোনো টিভি চ্যানেলে তাঁর মন্তব্য প্রকাশ করবেন না। কখনো আমার সুযোগ হবে না তাঁর ড্রয়িংরুমের ষাটের দশকের সোফায় বসে নানা বিষয়ে কথা বলার। তিনি বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য আর কখনো সেই নদীর দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে নৌকা ভাসাবেন না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁকে আর কখনো সোচ্চার হতে দেখা যাবে না। আমি হয়তো তাঁর পরিবারের কাছে প্রতিবেশী থাকব আরও কিছু দিন। কিন্তু তাঁর মতো করে কেউ বলবেন না ‘মান্নানের সাথে যুক্তিতে পারা যায় না।’ মোজাফ্ফর স্যারের গুণ ছিল অনেক। জীবনের সব কাজ বা সিদ্ধান্তে যে তিনি ত্রুটিমুক্ত ছিলেন তা-ও নয়। কারণ তিনি একজন মানুষ ছিলেন, কোনো মহামানব বা অতিমানব নন। তাঁর কর্ম তাঁকে আমাদের মাঝে চিরদিন স্মরণীয় করে রাখবে। স্যারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.