সরল গরল-প্রধান বিচারপতিকে চাপ দেওয়ার একটি ঘটনা by মিজানুর রহমান খান

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার নিয়োগে বড় ধরনের অস্বচ্ছতার ঘটনা ঘটেছে। অনেক প্রশ্নেরও জন্ম হয়েছে। পরীক্ষা নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, ‘গোয়েন্দা তথ্যের’ ভিত্তিতে, প্রধান বিচারপতি তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন।


আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ‘গোয়েন্দা তথ্য’ পেয়ে তিনি আর দেরি করেননি। গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান বিচারপতি পাল্টে দেন তাঁর সিদ্ধান্ত।
নতুন রেজিস্ট্রার পদে প্রধান বিচারপতি চারজনকে ডেকেছিলেন। আইন মন্ত্রণালয় এ সময় ওই পদে নিয়োগের জন্য মাত্র একজন জেলা জজের নাম পাঠায়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রধান বিচারপতি এতে খুবই অসন্তুষ্ট হন। কারণ রেওয়াজ হলো, রেজিস্ট্রার কে হবেন তা প্রধান বিচারপতিই ঠিক করেন। তিনি চারজনকে ডেকেছিলেন। এর মধ্যে কিন্তু সরকারের প্রস্তাবিত নামটিও ছিল। আইন মন্ত্রণালয় অবশ্য যেদিন তাঁর নাম করে চিঠি পাঠায়, সেদিনই তা প্রত্যাহার করে নেয়। এভাবে তাঁরা প্রধান বিচারপতির প্রতি ঠিকই সম্মান দেখায়। কিন্তু অপেক্ষায় থাকে।
২৭ এপ্রিলের বিকেল। প্রধান বিচারপতি একাই চারজনের মৌখিক পরীক্ষা নেন। পরদিন ফল প্রকাশ পেল। রেজিস্ট্রার হওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিরাশির বিশেষ ব্যাচের ফার্স্ট বয়। প্রধান বিচারপতি তাঁর চাকরি সুপ্রিম কোর্টে ন্যস্ত করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন। প্রথাগত নিয়মে এ আদেশ পালনে বিলম্ব ঘটে না। এ রকম চিঠি যেদিন সুপ্রিম কোর্ট থেকে যায়, সেদিন বা তার পরদিনই আইন মন্ত্রণালয় সে অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটল। প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত কার্যকর হলো না। প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়টি ঝুলে রইলো।
এ কথা দেশের প্রায় দেড় হাজার বিচারকের কাছে পৌঁছাতে হয়তো বেশি সময় লাগেনি। প্রধান বিচারপতি চারজনকে ডেকেছেন, এর মধ্যে কাকে বাছাই করলেন তা জানতে সংশ্লিষ্ট সবারই স্বাভাবিক আগ্রহ থাকে। কিন্তু সময় যায়, কিছুই জানা যায় না। জজশিপে, বিচার প্রশাসনে নানা জল্পনা-কল্পনা চলে। অনেকে ধরে নেন, প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত সরকারের মনঃপূত হয়নি। প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ার সেটাই প্রধান কারণ।
রেজিস্ট্রার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়টি ঝুলে থাকা অবস্থায় গত ১৭ মে সুপ্রিম কোর্ট একটি চিঠি পান। জানা গেছে, এতে রেজিস্ট্রার হিসেবে প্রধান বিচারপতির বাছাই করা বিচারকের পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে একটা জঙ্গি যোগসূত্র ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সরকারের এই চিঠি পাওয়ামাত্রই তাঁর আগের সিদ্ধান্ত পাল্টান। তিনি নতুন রেজিস্ট্রার হিসেবে অপর একজনকে নিয়োগ দেন। অবশ্য তিনিও ওই চারজনের অন্যতম। সেই অর্থে প্রধান বিচারপতির আস্থাভাজন বটে। সুতরাং আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের ঠিকই বলেন, রেজিস্ট্রার নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকার পরামর্শ করেছে।
কিন্তু তিনি তো আর পুরো বৃত্তান্ত বলেননি। অর্ধেকটা বলেছেন। অবশ্য তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিতে প্রস্তুত আছি যে, এখানে প্রধান বিচারপতির ওপর চাপ প্রয়োগ করার প্রশ্ন আসে না। বরং প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে নিরাপদ রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে আরও অনেক বড় প্রশ্ন দেখা দেয়, যার সদুত্তর পাওয়া অপরিহার্য।
প্রথম প্রশ্ন, আইনমন্ত্রী নিজেই ভালো জানবেন, রেজিস্ট্রার হিসেবে সরকার যে বিচারককে পছন্দ করলো না ওই বিচারকের কর্মস্থল এর আগে তিনি (আইনমন্ত্রী) নিজে উদ্যোগী হয়ে ঠিক করেছিলেন। সেটি হলো ঢাকার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে দিয়েছিলেন ঢাকার অদূরবর্তী একটি জেলায়। আইনমন্ত্রীর নিজস্ব এলাকায়। আইন মন্ত্রণালয় তা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়। কিন্তু একই ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি যেই রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দিলেন, অমনি আইন মন্ত্রণালয় বেঁকে বসল। এই দুটি নিয়োগের মধ্যে মাঝে সময় গেছে এক মাসের কিছু বেশি। ২৩ মার্চ থেকে ২৮ এপ্রিল। এরমধ্যে কী এমন ঘটল যে তাঁকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না? এই ঘটনা কার্যত প্রমাণ দেয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কত ঠুনকো। সরকার চাইলেই হলো।
দ্বিতীয়ত, আমরা জানতে পেরেছি, গত ১৭ মের চিঠিতে ওই বিচারকের পিতার মাদ্রাসা-শিক্ষকতার প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। তাঁর পিতা জামালপুরের সরিষাবাড়ী সদরের আরামনগর কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ (১৯৪১ থেকে ১৯৭৮) ছিলেন। শায়খ আবদুর রহমান ছিলেন ওই মাদ্রাসার ছাত্র। ১৯৮৬ সালে তিনি সেখান থেকে কামিল পাস করেছিলেন। এখানে অনেকেই জানতে চাইবেন, পিতার ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হওয়ার সঙ্গে পুত্রের বা এই পরিবারের জঙ্গিসূত্রের সম্পর্ক কোথায়? আমরা জেনে আরও অবাক হয়েছি, ওই অধ্যক্ষ ১৭ বছর আগে মারা গেছেন। ৩৭ বছর ওই মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পরে তিনি ওই মাদ্রাসা ছাড়েন ১৯৭৮ সালে। প্রথমে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছিলেন। তাঁর চার পুত্র। আলোচ্য বিচারক ছাড়া অপর দুজন যথাক্রমে হাইস্কুলের হেড মৌলভি ও একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত। অন্যজন একটি হাইস্কুলের কৃষিশিক্ষক। হেড মৌলভি ভ্রাতা ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাস করেছিলেন। তাঁর এক পুত্র লে. কর্নেল। জাতিসংঘ মিশনে রয়েছেন। তো এই যদি পরিবারের ইতিহাস হয়ে থাকে, তাহলে এর সঙ্গে জঙ্গিসূত্রের মিল কী করে হতে পারে? ‘মাওলানা রমজান সাহেব (বিচারকের পিতা) এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তাঁর জঙ্গিযোগসূত্র? প্রশ্নই আসে না। এটা অবশ্যই কারও উদ্ভট কল্পনা। স্রেফ গুজব।’ গত বুধবার টেলিফোনে এই মন্তব্য করেন সরিষাবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মালেক। তিনি সেখানকার আওয়ামী লীগের একজন নেতা। সত্তরের নির্বচনে এমসিএ এবং তিয়াত্তরে আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন।
আরেকটি কথা শুনেছি। এই বিচারকের বাড়ি ঢাকার ধামরাই থানার বড় জ্যাঠাইল গ্রামে। ওই চিঠিতে নাকি বলা হয়েছে, বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমান তাঁদের আত্মগোপনের শেষ দিনগুলোতে ওই গ্রামে কিছুদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধরা যাক, তাঁরা ওই গ্রামে ঠিকই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাতে কী প্রমাণ হয়? ওই গ্রামের সবাই জঙ্গি? জ্যাঠাইল গ্রামে দুই জঙ্গির আত্মগোপন প্রসঙ্গ যদি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার পদে কারও নিয়োগ বাতিলে কাজে লাগে, তাহলে সেটা তো মোটেই হেলাফেলার বস্তু নয়। সরকার তার ওই চিঠিতে উল্লিখিত কারণ দেখিয়ে বলেছে, রেজিস্ট্রার পদে এমন লোককে বসানো সমীচীন নয়।
আমাদের উদ্বেগ হলো, সরকার যদি তথাকথিত জঙ্গি যোগসূত্রের কারণে ওই পদে বসানো সমীচীন মনে না করে, তাহলে তাঁকে বিচারক পদে রাখা সমীচীন হবে কেন? সরকারের মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে চলবে কেন? নাগরিকেরা এ কথা জেনে কপাল কোঁচকাতেই পারেন। ওই চিঠিতে নাকি আরও বলা হয়েছে, তিনি বিএনপির আমলে সুপ্রিম কোর্টে ডেপুটি রেজিস্ট্রার ছিলেন। তাই বিএনপি ঘেঁষা। কিন্তু আমরা তো শুনতে পাই, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁকে ওই পদে বসিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মূল বিচারক গোলাম রসুল তখন ছিলেন রেজিস্ট্রার। আর তিনি যদি বিএনপির এত প্রিয় লোক হবেন, তাহলে তাঁর জাপান সফরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির একটি প্রস্তাব বিএনপি সরকার নাকচ করেছিল কেন? আওয়ামী লীগের আগের আমলে জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেতেও তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি। ঢাকায় দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-৪-এর বিচারক থাকাকালে জঙ্গিদের বিচারে অনভিপ্রেত কোনো বিঘ্ন ঘটার তথ্যও তো আমরা জানতে পারি না। তাহলে পছন্দ-অপছন্দ কোথায় ঘটল? বর্তমানে যাঁকে রেজিস্ট্রার করা হয়েছে তাঁকে আমরা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আইন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখেছি। তাতে কী দাঁড়ায়? এ ধরনের বিবেচনা কতটা উপযুক্ত ও সংগত? তাই আলোচ্য গোয়েন্দা তথ্য বিষয়ে একটি সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় তদন্ত কাম্য। বিচারক কেন বদনাম কুড়াবেন? কিংবা অযথা প্রশ্নের মুখে থাকবেন কিংবা আদৌ দোষী হলে শাস্তি পাবেন না কেন?
আমাদের মনে হচ্ছে, এই বিচারককে সরকার বা ব্যক্তিবিশেষ ‘নিজেদের বিশ্বস্ত লোক’ মনে করেননি। হয়তো ভেবেছেন, তিনি হবেন বেশি স্বাধীনচেতা। এই ভয় থেকেই কি তাঁদের আকস্মিক ‘গোয়েন্দা তথ্য’ সংগ্রহ? তবে এটা খুবই স্পষ্ট, উচ্চপদে কাউকে নিজেদের লোক ভাবতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হয়। প্রধান বিচারপতি গত ১৭ মে আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়ে নিজ সিদ্ধান্ত রদ করেন। বর্তমান রেজিস্ট্রারকে নিয়োগ দিতে প্রস্তাব করেন। আমাদের আইন মন্ত্রণালয় আর দেরি করেনি। তারা ওই দিনই প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু এভাবে তো বিচার প্রশাসন চলতে পারে না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মান-মর্যাদা ম্লান হয়। কথিত গোয়েন্দা তথ্য যদি অসার হয়, তাহলে তা তো শুধু অস্বচ্ছতা নয়, ঘোরতর অন্যায়। বড় উদ্বেগের কথা, কৌশল করে প্রধান বিচারপতিকে চাপে ফেলে কার্যসিদ্ধি করা।
ঘটনাটি আসলে রেজিস্ট্রার বা একই ধরনের পদে নিয়োগ প্রদানে যে একটি নীতিমালা ও বিধিবদ্ধ বাছাই-প্রক্রিয়া দরকার, সেটাই স্মরণ করিয়ে দেয়। গোয়েন্দা তথ্য নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু এর ওপর ভিত্তি করে পাকা সিদ্ধান্ত সংগত নয়। ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সমস্যা কোথায়? শুনানিব্যবস্থার প্রবর্তন তাই সর্বক্ষেত্রে চালু করা দরকার।
এই লেখা শেষ করার পর জানা গেল, ওই বিচারকের শ্বশুর নাকি জামায়াতের রোকন। এটাও তাঁর একটা অযোগ্যতা। সত্যি হলে বিবেচ্য বিষয় হতেও পারে। কিন্তু তা কি ব্যক্তি বিশেষকে শায়েস্তা করতে, নাকি এটি সর্বক্ষেত্রে নীতি হিসেবে প্রযোজ্য ও কার্যকর হতে হবে? মনে পড়ল বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদের রায়। ২০০৮ সালে দশ বিচারকের মামলার রায়ে তিনি তথ্য দেন, জোট সরকারের আমলে জামায়াতের দুজন রোকনকে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই দেশে ব্যক্তি নিজে জামায়াতের রোকন হয়ে বিচারপতি হিসেবে কাজ করে যাবেন, আর শ্বশুর রোকন হলে রেজিস্ট্রার হওয়া যাবে না কেন?
গত ২ জুন আমি ওই বিচারকের শ্বশুর মো. সিরাজুল ইসলামকে ফোন করি। জানতে চাই, আপনি কি জামায়াত করেন বা কখনো সংশ্লিষ্ট ছিলেন? আমাদের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নাকি তেমন তথ্য জানতে পেরেছে। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৭৮। সমবায় বিভাগে সরকারি চাকরি করেছি তিন দশকের বেশি। জীবনে কখনো কোনো দল করিনি। আমার ছেলেমেয়েরাও কেউ কোনো দল করেনি। আপনি যে কথাটা বললেন সেটা মিথ্যা, আজগুবি।’
তবু আমরা গোয়েন্দা তথ্যকে নাকচ করব না। তবে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে বলব, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। প্রধান বিচারপতিকে দৃশ্যত চাপ দেওয়ার এই ঘটনার পুরো সত্য আমরা জানতে চাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.