কলকাতার চিঠি-পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পরিবর্তনের হাওয়া by অমর সাহা

এমনটা ভাবেনি পশ্চিমবঙ্গের শাসকগোষ্ঠী বামফ্রন্ট। ভাবেনি বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস, এমনকি জাতীয় কংগ্রেসও। এ তিনটি দল বা জোটের ধারণা ছিল, পশ্চিমবঙ্গে সদ্য অনুষ্ঠিত ৮১টি পৌরসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট হারবে ঠিকই, তবে এত বিপুল ভোটে যে হারবে সেটা তাদের কল্পনাও ছিল না।


পৌরসভা নির্বাচনে এবার যেভাবে হেরেছে, তাতে মনেই হয় না যে মানুষ বামফ্রন্টকে ফের মেনে নেবে। বরং মানুষ এখন বুঝে নিয়েছে যে এই পৌর নির্বাচনের মাধ্যমে বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। পরিবর্তনের হাওয়া চলছে গোটা রাজ্যজুড়ে। মানুষ পরিবর্তন চাইছে। ৩৩ বছরের বামফ্রন্টের শাসন থেকে মুক্তি চাইছে। চাইছে মমতার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে আসুক এক নয়া বিপ্লব, নতুন শাসন।
১৯৭৭ সালের ২১ জুন এই বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। ওই দিন রাজ্যপাল এম এল ডায়াসের কাছে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন জ্যোতিবসু। তারপর একে একে কেটে গেছে বহু বছর। কংগ্রেসের আর এমন কোনো নেতা তৈরি হয়নি, যিনি এই বামফ্রন্টের গদিকে টলিয়ে দিতে পারেন। বরং কংগ্রেস বহুবার আপসের রাজনীতি করে এসেছে। এটাই সেদিন পছন্দ হয়নি যুব কংগ্রেসনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে শুরু করেন আন্দোলন। ইতিমধ্যে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির নির্বাচন নিয়ে মমতার সঙ্গে রাজ্য কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের বিবাদ বাঁধে। মমতা প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির পদে দাঁড়িয়েও হেরে যান সোমেন মিত্রের কাছে। সেই সোমেন মিত্র এখন মমতার দলের সাংসদ। এসব ঘটনার পর মমতা সিপিএমের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ার জন্য সেই ১৯৯৭ সালে পৃথকভাবে গড়েন তৃণমূল কংগ্রেস। তারপর সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে চালিয়ে যান লাগাতার আন্দোলন।
মমতার এই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের আন্দোলন। এই আন্দোলনই মমতাকে রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করে বিরোধী শক্তির আধার হিসেবে।
হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটার একলাখি গাড়ি কারখানা নির্মাণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার টাটাকে ৯৯৭ একর জমি দেয়। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ওই জমিতে বেড়া দিতে যায় টাটা। আর তখনই এ জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন মমতা। মমতার দাবি, কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের মুখে পড়ে টাটা এ রাজ্য ছেড়ে চলে যায়।
এর পরের ঘটনা নন্দীগ্রামের। পূর্ব মেদিনীপুরের এই নন্দীগ্রামে রাজ্য সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার জন্য উদ্যোগ নিলে মমতা ফের রুখে দাঁড়ান। গড়ে তোলেন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। চলে আন্দোলন। যদিও নন্দীগ্রামে রাজ্য সরকার কোনো জমি অধিগ্রহণ করেনি। কেবল ঘোষণা দেওয়ার পরই শুরু হয় এই আন্দোলন। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ এই নন্দীগ্রামে ঘটে গণহত্যার ঘটনা। এদিন আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় নিহত হয় ১৪ গ্রামবাসী। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে। চাঙা হয়ে যায় মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। নন্দীগ্রামে মমতার এই আন্দোলনের সময় মাওবাদীরাও গোপনে উৎসাহ যোগায় মমতাদের। এ দুটি আন্দোলনের মাঝেই ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন। এ নির্বাচনেই প্রথম ধ্বস নামে বামফ্রন্টে। গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪১ হাজার ৫০৪টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পায় নয় হাজার ৩৭৫টি আসন। যদিও বামফ্রন্ট জয়ী হয় ২১ হাজার ৬৯১টি আসনে, এখান থেকেই শুরু হয় মমতার জয়যাত্রা। ২০০৯ সালের লোকসভার নির্বাচনেও মমতা পান বিপুল জয়। ২০০৪ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে মমতা পেয়েছিলেন মাত্র একটি আসন। তাও নিজের আসনটি। এ নির্বাচনে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস একাই ছিনিয়ে নেয় ১৯টি আসন। কংগ্রেস ছয় এবং বামফ্রন্ট ১৫টি। এরপর এবার পৌরসভার নির্বাচন।
এ পরিবর্তনের ধারাকে কাঁধে নিয়ে চলেছেন মমতা। মাঝে ছোট্ট একটি দুর্ঘটনা ঘটে। এই পৌর নির্বাচনের আগে মমতার সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের আসন ভাগাভাগি প্রশ্নে ভেঙে যায় জোট। ফলে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস পৃথকভাবে লড়ে এ নির্বাচনে। ফলাফলে মমতা রাজ্যবাসীকে দেখিয়ে দিলেন, তিনি একাই পারেন সিপিএমকে হটাতে।
এ নির্বাচনে কলকাতা পৌর করপোরেশনের ১৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ছিনিয়ে নেয় ৯৫টি ওয়ার্ড। বামফ্রন্ট পায় মাত্র ৩৩টি ওয়ার্ড। কংগ্রেস পায় ১০টি এবং বিজেপি পায় ৩টি ওয়ার্ড। বিধাননগর পৌরসভার ২৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল পায় ১৬টি এবং বামফ্রন্ট নয়টি ওয়ার্ড। রাজ্যের অন্য ৭৯টি পৌরসভার মধ্যে তৃণমূল জয়ী হয়েছে ২৪টিতে, বামফ্রন্ট ১৭টিতে, কংগ্রেস ৭টিতে এবং ২৮টি পৌরসভার ফলাফল হয়েছে অমীমাংসিত। চারটি পৌরসভায় কোনো দলই পৌর বোর্ড গড়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
এবারের এই পৌর নির্বাচনের পর পরবর্তী সময় যাতে কোনো অঘটন না ঘটে, সেই লক্ষ্যে তৃণমূল ও জাতীয় কংগ্রেস আবার কাছাকাছি এসেছে। দুই দলই এবারের ফলাফলে বুঝেছে, সিপিএমকে এ রাজ্যপাট থেকে হটাতে গেলে তৃণমূল ও জাতীয় কংগ্রেসের ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছাড়া বিকল্প পথ খোলা নেই। সেই লক্ষ্যেই তৃণমূল কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, এবারের পৌর নির্বাচনে যে ২৮টি পৌরসভায় ত্রিশঙ্কু ফলাফল হয়েছে, সেখানে কংগ্রেস ও তৃণমূল মিলে পৌর বোর্ড গঠন করবে। এই বার্তা দিয়ে দুটি দলই ঘোষণা দিয়েছে, ২০১১ সালের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস ফের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ে হটিয়ে দেবে এ রাজ্যপাট থেকে। যদিও কংগ্রেস ও তৃণমূল চাইছে ২০১১ সালের নির্বাচন এগিয়ে এনে বিধানসভার নির্বাচন সেরে নিতে। তাদের লক্ষ্য পরিবর্তনের এই হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করা। যদিও সিপিএম বলে দিয়েছে, বিধানসভা নির্বাচন আগাম নয়, যথাসময়ই অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে সিপিএম এখনো আশাবাদী, রাজ্যবাসী তাদের ক্ষমতা থেকে হটাবে না।
পঞ্চায়েত, লোকসভা ও পৌরসভার নির্বাচনে তৃণমূলের ব্যাপক জয়ের পর রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও বুঝে নিয়েছেন, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে আর গদি ধরে রাখতে পারবে না বামফ্রন্ট। পরবর্তী সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই। মমতার কথায় বামফ্রন্টের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। পরিবর্তনের ছোঁয়া এবার আঘাত করেছে গোটা রাজ্যজুড়ে। এবারের পৌরসভা নির্বাচনে মমতা দখল করে নিয়েছেন কলকাতার দুই নম্বরের লাল বাড়িটিকে, অর্থাৎ কলকাতা করপোরেশন বিল্ডিংকে। এবার লক্ষ্য এক নম্বর লাল বাড়িটির দিকে। এক নম্বর লাল বাড়িটি হলো বর্তমান রাজ্য সচিবালয় বা রাইটার্স বিল্ডিং। মমতা বহুদিন ধরে পা রাখছেন না এক নম্বর লাল বাড়িটিতে। দলের নেতারা বলেছেন, বিজয়ীর বেশেই মমতা ওই লাল বাড়িতে পা রাখবেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.