পরিসংখ্যান ব্যুরো-দোষ না দিয়ে ঘাটতি মেটান by আসজাদুল কিবরিয়া

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-পরিসংখ্যান ছাড়া নীতি-নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের কাজ দুরূহ হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও নীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও সত্য। তবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণ ও পরিচালনায় এই সত্যটি গ্রহণ করে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে এক ধরনের অনীহা পরিলক্ষিত হয়।


এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে চারটি পৃথক পরিসংখ্যানমূলক প্রতিষ্ঠানকে একত্র করে গঠন করা হয় বিবিএস। প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল: পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষিশুমারি কমিশন ও আদমশুমারি কমিশন। সমন্বিতভাবে জাতীয়-ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যান ও উপাত্ত সংগ্রহ, সংকলন ও প্রকাশ করার দায়িত্ব অর্পিত হয় বিবিএসের ওপর। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ গঠন করে বিবিএসএর দেখভাল ও পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই বিভাগের সচিব একই সঙ্গে বিবিএসের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করতেন। তবে, ২০০২ সালে পরিসংখ্যান বিভাগ অবলুপ্ত করা হয়। বিবিএসের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কমকর্তাকে। বলা যেতে পারে, এর মধ্য দিয়ে বিবিএসকে প্রচলিত প্রশাসনিক কাঠামোয় এক স্তর নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে তথ্য-পরিসংখ্যান বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সরকারের অনীহার একটি প্রতিফলন ঘটে।
অবশ্য তার আগের ১৭ বছর যে বিবিএস খুব ভালোভাবে কাজ করেছে, তাও নয়। বিবিএসের কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনা ও জাতীয় পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে শক্তিশালী করার জন্যও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও নিরবচ্ছিন্নভাবে তা বাস্তবায়নের জোরোলো কোনো চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের যে জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল, যাওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হয়ে ওঠেনি। করেছেন। অভিযোগ করেছেন এই বলে যে বিবিএস অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক চিত্র তুলে ধরছে না। কিন্তু বিবিএসকে শক্তিশালী করা, সঠিকভাবে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে কর্মদক্ষ করে তোলার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা দেখিনি।
অথচ বিভিন্ন সময়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিরা বিবিএসের এই দুর্বলতাকে ভিত্তি ধরে বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও উপাত্তে দুর্বলতার জন্য সংস্থাটিকেই দায়ী করেছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী সাইফুর রহমান একাধিকবার বিবিএসকে দোষারোপ
আশ্চর্যজনকভাবে এবারও একই রকম একটি প্রবণতা দেখা গেল। বিবিএস ২০০৯-১০ অর্থবছরের জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। এতে দেখানো হয়েছে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। আরও দেখানো হয়েছে যে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বেশ কমে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান এর দুই দিন পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় এই বলে বিবিএসকে দুষলেন যে তাদের হিসাবপদ্ধতিতে গলদ রয়েছে, তারা প্রবৃদ্ধির সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারছে না। তার দুই দিনের মাথায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে বিবিএস কৃষি উৎপাদনের বিষয়ে সঠিক হিসাব দেয়নি। ফলে কৃষি প্রবৃদ্ধি কম দেখানো হয়েছে। তিনি নিজ কার্যালয়ে ডেকে এনে বিবিএসের কর্মকর্তাদের তিরস্কারও করেছেন। এও বলেছেন যে কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিবিএস, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও এসপারসো ভিন্ন ভিন্ন হিসাব দিচ্ছে এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই।
মন্ত্রী ও গভর্নর যা বলেছেন, তা মারাত্মক। যেহেতু তারা দায়িত্বশীল, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় যে তাদের অভিযোগের যৌক্তিকতা ও ভিত্তি আছে। প্রশ্ন হলো, বিবিএসকে এভাবে দোষারোপ করে কী লাভ? সংস্থাটির দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তারা নিশ্চয়ই আজকে হঠাৎ করে অবহিত হননি। গত দেড় বছরে এই বিষয়ে অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা তাদের হয়েছে কি না, তাও জানা যায় না। তবে, সরকারের দুজন গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারক যখন বিবিএসের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে বলছেন, তখন পুরো বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সমস্যা হলো, যখনই যে সরকার আসে, তখনই সে সরকার বিবিএসের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সাবেক এক অর্থমন্ত্রী সম্পর্কে এ রকমও একটা গল্প সাংবাদিক মহলে প্রচলিত ছিল যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেলে তিনি বিবিএসকে ধমক দিয়ে তা একটু কমিয়ে দেখাতে বলতেন। হয়তো ঘটনাটি সত্যি নয়। কিন্তু তথ্য-পরিসংখ্যান মনমতো করার জন্য চাপ দেওয়ার বিষয়টি মোটেই মিথ্যা নয়।
সরকারের রাজনৈতিক চাপ দেওয়ার পাশাপাশি রয়েছে তথ্য গোপন করার বা সব পরিসংখ্যান পুরোপুরি প্রকাশ না করার পুরোনো অভ্যাস, যে কারণে বিবিএস একটি রক্ষণশীল সংস্থায় পরিণত হয়েছে। বিবিএসের জন্য বাজেটের বরাদ্দেও রয়েছে রক্ষণশীলতা। ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে বিবিএসের জন্য মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬২ কোটি টাকা। আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৯ কোটি টাকা। আছে লোকবলের ঘাটতি। বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগও ব্যাপকভিত্তিক নয়। অর্থ ও লোকবল-সংকটের কারণে বিবিএসের পক্ষে সব সময় বিজ্ঞানসম্মতভাবে জরিপ পরিচালনা ও পরিসংখ্যান তৈরির কাজ সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে ওঠে।
বিবিএসের আর্থিক সংস্থানের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প কিছুটা সহায়ক হয়েছে। এসব প্রকল্প যেহেতু বাইরে থেকে অর্থায়ন হয়েছে ও হয়, সেহেতু এর আওতায় পরিচালিত জরিপ ও প্রাপ্ত উপাত্তও আবার অনেক সময় ওই প্রতিষ্ঠানের একক নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
অন্যদিকে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার তরফ থেকে সেভাবে তথ্য-উপাত্তের চাহিদা তৈরি না হওয়ায় বিবিএসকে সেগুলো জোগান দিতে হয়নি। ফলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও পরিসংখ্যান প্রতিবেদন প্রস্তুত করার কাজটি পিছিয়ে আছে। আবার ওয়েবসাইটে নিয়মিত পরিসংখ্যান প্রকাশ করার কাজটিও সবসময় ঠিকমতো হচ্ছে না।
বিবিএসের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো আমলাতন্ত্রের প্রভাব। মাঠপর্যায়ে জরিপ পরিচালনা ও তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু তথ্য-উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ ও উপস্থাপনের মতো কৌশলগত কাজগুলো পরিসংখ্যানবিদ ও তাদের সহযোগীরাই করে থাকেন। এসব কাজে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ করার জন্য অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণসহ আধুনিক কারিগরি সহায়তা জরুরি।
কিন্তু পরিসংখ্যানবিদ নন বা পরিসংখ্যানের বিষয় সম্যক জ্ঞানের ঘাটতি আছে এমন আমলা দিয়ে এই সংস্থা পরিচালনা করার দীর্ঘদিনের চর্চা বিবিএসকে সমৃদ্ধ করার পথে বাধা হিসেবেই কাজ করেছে। এসব আমলার দূরদৃষ্টি ও বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে কাজের চিন্তার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভারতে পরিসংখ্যান বিভাগের সচিবকে হতে হয় পেশাগতভাবেই একজন পরিসংখ্যানবিদ এবং তিনি প্রধান দেশের প্রধান পরিসংখ্যানবিদ।
নীতি-নির্ধারকদের তাই এখন বিবিএসকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অবশ্য আবার পরিসংখ্যান বিভাগ চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতি সম্প্রতি এই বিভাগ চালুর একজন সচিবও নিয়োগ করা হযেছে। তবে বিভাগটি সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেনি। অন্যদিকে, প্রয়োজন না থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং বিভাগকে নতুনভাবে চালু করা হয়েছে। বিবিএসকে পেশাগতভাবে দক্ষ করে তোলার জন্য সংস্থাটির স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন বলেও বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।
এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকানো যেতে পারে। ভারতে একটি পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয় রয়েছে, যার দায়িত্বে আছেন একজন প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য আছে জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন। এই কমিশনকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কমিশন চাইলে যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে তলব করতে পারে, জাতীয় পরিসংখ্যানের জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো দলিল চাইতে পারে।
বস্তুত, উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে বিশেষত অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীকেই এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক-আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত করে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতা দিয়ে বিবিএসকে পুনর্গঠন করার জন্য ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে অর্থবহ বরাদ্দ দেওয়াটা খুব জরুরি।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.