চরাচর-দীর্ঘ হচ্ছে সাইক্লোন সিজন by আজিজুর রহমান

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে ১০০ বছরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ০.৫ মিটার। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসির রিপোর্ট পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার হার বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি।


সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার হার প্রতিবছর যেখানে ২.২ মিলিমিটার, সেখানে উপকূলে বঙ্গোপসাগরের উচ্চতা বাড়ার হার প্রতিবছর পশ্চিমে হিরন পয়েন্টে ৪ মিলিমিটার, মধ্যাংশে চরছেঙ্গায় ৬ মিলিমিটার এবং পূর্বাংশে কঙ্বাজারে ৭.৮ মিলিমিটার। একসঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের পানির উত্তাপও। ফলে জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ ও লঘুচাপের মতো সামুদ্রিক দুর্যোগের সংখ্যা, শক্তি ও স্থায়িত্বের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার বিরূপ প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর প্রথমটি হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও পানির উত্তাপ বাড়া অব্যাহত থাকায় বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির মৌসুম অর্থাৎ সাইক্লোন সিজনের দৈর্ঘ্য বাড়ার আশঙ্কা। উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির মৌসুম বা সাইক্লোন সিজন হচ্ছে বর্ষাপূর্ব এপ্রিল-মে এবং শীতপূর্ব অক্টোবর-নভেম্বর মাস। এ কারণে এখন জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও জুলাই মাসেও সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাবে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা, স্থায়িত্ব ও শক্তি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উত্তাপ আরো ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ২১ থেকে ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। আইপিসিসির রিপোর্টে বলা হয়েছে, পানির উত্তাপ ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ট্রপিক্যাল ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সামুদ্রিক ঝড়গুলোও অধিকতর শক্তিশালী হবে। কয়েক বছর ধরে দেশে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়ে গেছে। কমে আসছে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির ব্যবধান। আগে ১০, ১৫ কিংবা ২০ বছর পর পর ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও এখন এ ব্যবধানের সময়টা চার-পাঁচ বছরে নেমে এসেছে। ঘূর্ণিঝড়ের স্থায়িত্বও বেড়ে যাচ্ছে। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর আঘাত হানা গোর্কি নামের ঘূর্ণিঝড়টির স্থায়িত্ব ছিল পাঁচ ঘণ্টা, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল হারিকেনরূপী ঘূর্ণিঝড়ের স্থায়িত্ব ছিল ১১ ঘণ্টা এবং ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডর নামের সুপার সাইক্লোনটির স্থায়িত্ব ছিল ২৪ ঘণ্টা। ইউএনডিপির প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির দিক থেকে বাংলাদেশই শীর্ষে। ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্বের প্রাণহানির ৫৩ শতাংশই ঘটে বাংলাদেশে। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে ফিলিপাইন তিন গুণ বেশি এগিয়ে থাকলেও মৃত্যুর সংখ্যা ফিলিপাইন থেকে বাংলাদেশে ১০ গুণ বেশি। এটা প্রমাণিত সত্য যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস। এ ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনা কিংবা একেবারে বন্ধ করা সম্ভব হলেও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও পানির উত্তাপ বৃদ্ধি কয়েক শতাব্দী ধরে অবিরাম চলতেই থাকবে। সুতরাং ঘূর্ণিঝড়ের ছোবল থেকে আমরা খুব সহজে নিষ্কৃতি পাচ্ছি না।
আজিজুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.