ধারাবাহিক মিমি

তাঁর জীবনের দর্শন হচ্ছে, কর্মেই মুক্তি। ব্যক্তিজীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছাপিয়ে পরিচালনার কাজটি এখন তাঁর কাছে মুখ্য।বন্ধন দিয়ে যাত্রা শুরু, এরপর গৃহগল্প, সাড়ে তিন তলা, কাছের মানুষ, ডলস হাউজ। এবার পৌষ ফাগুনের পালা।


আর কদিন পরই টিভি পর্দায় গজেন্দ্রকুমার মিত্রের উপন্যাস অবলম্বনে পৌষ ফাগুনের পালা নাটকটি নিয়ে আসছেন আফসানা মিমি।
ভীষণ ব্যস্ত তিনি। শুটিং করেছেন প্রায় ৫০ পর্বের। এখন সম্পাদনার কাজ চলছে। বললেন, ‘কেউ যখন আমার কাজ নিয়ে সমালোচনা করে, যেমন যদি কেউ আমার নাটকের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলে, তবে আমি তা গ্রহণ করি এবং তা নিয়ে ভাবতে থাকি। কিন্তু কেউ আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সমালোচনা করলে তা না শোনার চেষ্টা করি। কে কী বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। কী কাজ করছি, সেটাই বিচার্য বিষয়।’
এই মনোভাবকে মূলমন্ত্র করে মিমি মঞ্চনাটক থেকে শুরু করে টিভি নাটকে অভিনয় ও পরিচালনায় ২৫টি বছর পার করেছেন।
গত ২৭ মে কাজের ব্যস্ততার কারণে সেদিনের সব কর্মসূচি বাতিল করেছিলেন মিমি। সেদিনই সময় দিলেন কথা বলার জন্য। বিকেল চারটায় তাঁর কৃষ্ণচূড়া শুটিং স্পটে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই দেখা মিলল। ফ্লাস্ক থেকে এক মগ ধূমায়িত চা নিয়ে বসে পড়লেন। মুখে তাঁর সেই চিরচেনা হাসি। প্রায় ২৫ বছর আগে অভিনয় শুরু করেছিলেন। সময় পার হয়েছে অনেক, কিন্তু নিজেকে আগের মতোই ধরে রেখেছেন এক আশ্চর্য মন্ত্রবলে।
কী সেই মন্ত্র?
প্রশ্ন শুনে মিমি হাসেন। সুখী মানুষের হাসি। ‘আসলে আমার জীবনে টেনশন খুবই কম। ৩৬৫ দিনের মধ্যে বোধ হয় পাঁচ দিনও মন খারাপ থাকে না। রাতের বেলা ঘুমটা ভালো হয়। আর পরনিন্দা, পরচর্চা, অযথা অন্যের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে আফসোস করা—এসব থেকে দূরে থাকি। ফলে নিজের শরীরের ওপর কোনো ধরনের চাপ পড়ে না। আমি ভীষণ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। আমার একটা নিজস্ব জগৎ আছে। সে জগতের প্রায় সবাই উত্তরায় থাকেন। কাজ না থাকলে সবাই মিলে আড্ডায় বসে যাই। নানা হাস্যরসেই আমাদের সময়গুলো কেটে যায়। ফলে সময় কেটে গেলেও মনে বয়সের ছাপ পড়েনি। তবে পরিবর্তন কিছুটা এসেছে।’ নিজের মাথার চুল দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে দেখুন না, মাথার অনেক চুল সাদা হয়ে গেছে। এ নিয়েও আমার কোনো টেনশন নেই। আমাদের পরিবারের মধ্যে একটা লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আমার বাবাকে দেখলে কেউ বলবে না যে মানুষটার এত বয়স হয়েছে। আমার বড় বোনকে দেখলেও কেউ বুঝতে পারবে না যে তার অনেক বয়স হয়েছে। আমার ব্যাপারটাও অনেকটা সে রকম। আসলে এটা ঈশ্বর-প্রদত্ত। তাই অনেকেই প্রশ্ন করেন, “তুমি কি বড় হবে না?” শুনে আমি হাসি।’
হাসি-খুশি মিমির জীবনে কি কষ্ট নেই?
সামান্য সময়ের জন্য মিমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন। ‘থাকবে না কেন? কিন্তু সেই কষ্টের বহিঃপ্রকাশ খুবই কম। বাইরের মানুষের কাছ থেকে কোনো কষ্ট পাওয়াকে কষ্ট বলে মনে হয় না। কিন্তু কাছের মানুষজনের কাছ থেকে যখন আঘাত পাই, তখন খুবই কষ্ট হয়। কষ্ট দূর করার জন্য চলে যাই শপিংয়ে। একা একা বিভিন্ন দোকান ঘুরে কেনাকাটা করি। গাড়িতে ঘুরে বেড়াই। একসময় বাসায় ফিরে আসি। ভুলে যাই সবকিছু। আমি যেকোনো দুঃসহ পরিবেশকে মানিয়ে নেওয়ার মতো একটা মেয়ে। তাই খুব বেশি শোকার্ত হই না।’ বলছিলেন মিমি।
সংসার-জীবনের পাট চুকিয়েছেন মিমি অনেক আগেই। কিন্তু এরপর আর সংসার বাঁধেননি। এর পেছনে কোনো কারণ আছে কি?
মিমির সোজা-সাপ্টা উত্তর, ‘আসলে এমন কোনো পরিকল্পনা করিনি যে আমি আর বিয়ে করব না। আবার বিয়ে যে করব এমনটাও ভাবি না। মানুষের জীবনে কিছু সুসময় আসে, আবার তা চলেও যায়। আমার জীবনেও সে রকম কিছু ঘটনা ঘটেছে। গাজী রাকায়েতের সঙ্গে ১৯৯৬ সালে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর অনেকেই আমাকে আজ অবধি একটি কথা বলেন, “তোমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। বিয়ে থা করো। কারণ একটা সময় আসবে, যখন তোমাকে দেখার কেউ থাকবে না। তখন তুমি বুঝবে, একটি সন্তানের তোমার প্রয়োজন ছিল।” আমি তাদের বলি, “ভাই, অনেক সন্তান আছে, যারা বাবা-মাকে দেখে না। তাই বলে কি বাবা-মায়ের দিন চলছে না।” আসলে আমি এত সাত-পাঁচ ভাবি না। বিয়েটা ভাগ্যের ব্যাপার বলে বিশ্বাস করি। মাঝে একটা ঘটনা ঘটেছে, এ জন্যও যে আমি খুব আপসেট, তাও নয়। কাজ করছি। কাজের মধ্যে ডুবে আছি। যদি হয় কখনো হুট করে বিয়ে হবে। তা না হলে জীবনটা কাজের মধ্যেই কেটে যাবে। আমার জীবনের দর্শন হচ্ছে, কর্মেই মুক্তি।’ বললেন মিমি। তারপর চায়ের মগে চুমুক।
বলি, অভিনয়শিল্পীদের অনেকেই এখন নাটক নির্মাণে ব্যস্ত। আপনার অনেকগুলো কাজ প্রশংসিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, মিমি তাঁর কাজটা বেশ যত্ন নিয়ে, গুছিয়ে করেন। তাঁর কাজের মধ্যে পেশাদার মনোভাব থাকে।
জবাবে বললেন মিমি, ‘আমি কয়েকজন মানুষের কাছ থেকে কাজ শিখেছি। এর মধ্যে আছেন আমার থিয়েটার দল নাগরিকের আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর। তাঁদের কাছ থেকে আমি যে শিক্ষা পেয়েছি, তা আমি এখন আমার কর্মজীবনে কাজে লাগাচ্ছি। আর যখন আমি মাছরাঙায় কাজ শুরু করলাম তখন অঞ্জন স্যার (অঞ্জন চৌধুরী) আমাকে একটি কথা বলেছিলেন, আর তা হলো, “তুমি যা-ই করো, সেগুলো কিছুদিন পর মানুষ ভুলে যাবে। কিন্তু রয়ে যাবে তোমার কাজ।” সেই একটি কথাই আসলে আমাকে সব সময় মনে করিয়ে দেয়—এমন কাজ করতে হবে, যে কাজ মানুষের স্মৃতিপটে রয়ে যাবে। আমি চেষ্টা করি কাজগুলো সেভাবেই করার জন্য। একটি কাজ করার আগে দশবার ভেবে নিই। জানি, কাজ করার পর ভাবনার কোনো মূল্য নেই। যে কাজটাই করি, সেটি সততার সঙ্গে করার চেষ্টা করি। এ জন্যই কিন্তু আমার কাজগুলো কম-বেশি আলোচনায় উঠে এসেছে। যেমন বন্ধন করার পর সাড়ে তিনতলা করলাম। এরপর কাছের মানুষ করলাম। মানুষ কাছের মানুষ ভালোভাবেই নিল। ডলস হাউজ করলাম। এর সম্পর্কেও আলোচনা হলো। আমি আশাবাদী পৌষ ফাগুনের পালা নিয়েও।’
অভিনয় থেকে পরিচালনা। নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন মিমি। বললেন, ‘যেদিন আমি ফেরদৌসী মজুমদারকে নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করলাম, সেদিন কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। ভাবছিলাম, এত বড় অভিনেত্রী, তাঁকে কী নির্দেশনা দেব! দেখলাম, তিনিই আমার সব জড়তা কাটিয়ে দিলেন। আমাকে অভয় দিলেন। আমি স্বচ্ছন্দে এখন তাঁকে নিয়ে কাজ করছি। হুমায়ুন ফরীদি অনেক বড় অভিনেতা। তাঁকে নিয়ে যখন পরিচালনা শুরু করলাম, তাঁর বেলায়ও এমনটি ঘটল। আসলে তাঁদের সহযোগিতা আছে বলেই পরিচালক হিসেবে ভালোভাবে কাজটা করতে পারছি।’
দিনের আলো কমে এসেছে। ঘর ছেড়ে বাইরে এলেন মিমি। চমৎকার বাতাস বইছে। আকাশে একটু একটু করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মিমির কাছে জানতে চাইলাম, আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
‘তেমন কোনো কিছু নেই। ভালোভাবে কাজ করতে চাই, কাজের মধ্য দিয়ে বাঁচতে চাই। সুস্থ থাকতে চাই।’

No comments

Powered by Blogger.